‘এত বড় আন্দোলন হল, তারপরও সচেতনতা নেই’

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরও রাস্তায় চলাফেরায় সাধারণ নাগরিকরা সচেতন না হওয়ায় আক্ষেপ ঝরেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2018, 01:41 PM
Updated : 13 Sept 2018, 02:54 AM

জাতীয় সংসদের বুধবারের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা বলেন, “এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটল, এরকম একটা আন্দোলন হল, তারপরও আমরা দেখি মানুষের মধ্যে সে সচেতনতা নাই। যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছে।”

গত জুলাইতে বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই স্কুলশিক্ষার্থীর মৃত্যুর পড় আন্দোলনে নামে ছাত্র-ছাত্রীরা, যা পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

টানা ১০ দিনের সেই আন্দোলনের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তায় নেমে গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করতে দেখা যায়। রাস্তায় যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টাও করে তারা।

কিন্তু ওই আন্দোলনের পর ঢাকার রাস্তায় আইন অমান্য করার পুরনো চিত্র আবার দেখা যায়, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে।

সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ নূর ই হাসনা চৌধুরীর সম্পূরক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী নাগরিকদের অসচেতনতার কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন।

“এমনকি পত্রিকায় ছবি ওঠেছিল- এক বাবা বাচ্চাকে বুকে নিয়ে .. ফেন্সের মাথাগুলো সরু করে উঁচু করে দেওয়া, সে মাথাগুলো ডিঙিয়ে এমনভাবে পার হচ্ছে, কোনোভাবে যদি পা স্লিপ করে তাহলে ওই বাচ্চা ওই ফেন্সের সরু মাথায় একেবারে গেঁথে যাবে, সেখানেই মৃত্যু হবে। বাবার কি এই সচেতনতা থাকা উচিত ছিল না? সচেতনতার যথেষ্ট অভাব আমাদের। এত বড় একটা ঘটনার পরও দেখবেন, বাচ্চার হাত ধরে দ্রুত রাস্তা পার হচ্ছে।”

রাস্তা পারাপারে সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সুরে বলেন, “একটা অদ্ভুত মানসিকতা এদেশের মানুষের আছে যে তারা রাস্তা পারাপারের সময়, মানে একটা দ্রুত যান আসছে হাত দেখানোর সাথে সাথে গাড়িটা থেমে যেতে পারে না। এটা যারা গাড়ি চালায় তারা বলতে পারবে .. পট করে গাড়ি থামতে পারে না। আমরা কী দেখি, ছোট্ট শিশুর হাত ধরে মা রাস্তায় চলে যাচ্ছে অথবা বাবা বাচ্চাদের নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এমনভাবে একটা… যেখানে অনবরত গাড়ি আসছে।”

তরুণদেরও ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতার প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, “… তাদেরও দেখেছি কাছেই ওভারপাস আছে.. যেতে পারে.. সেখানে না গিয়ে ফট করে দৌঁড় মেরে পার হতে চায়। তার ফলে অ্যাকসিডেন্ট হয়। অ্যাকসিডেন্ট হলে এটাও বিবেচ্য বিষয় যারা রাস্তা পারাপার করছে তাদের দোষ কতটুকু দেওয়া যায়, সেটাও দেখা দরকার।

“আরেকটা বিষয় হয়- সেটা হল কোনো একটা অ্যাকসিডেন্ট হল বা গাড়িতে ধাক্কা লাগল, ড্রাইভার তখন জীবন বাঁচাতে এর ওপর দিয়ে দ্রুত চলে যেতে চেষ্টা করে। ফলে যার বাঁচার সম্ভাবনা ছিল, বাঁচে না।”

ফুটব্রিজের নিচে পিলারের সামান্য ফাঁকা থেকে রাস্তা পার হতে চেষ্টা করছেন এক পথচারী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কেন যাওয়ার চেষ্টা করে? তার কারণ হল আমাদের মানুষের অবস্থাটা এরকম, যে ধাক্কা খেল তাকে বাঁচানোর থেকেও বেশি আগ্রহ হয়ে যায় ড্রাইভারকে টেনে নামিয়ে মারধর করা এবং মারতে মারতে এমনও ঘটনা ঘটে মেরেই ফেলে। আইন কারো হাতে তুলে নেওয়া উচিত না। মারধর যদি বন্ধ হয় তাহলে অনেক অ্যাকসিডেন্ট কমে যায়; এটা হল বাস্তবতা।”

রাস্তা পারাপারে ট্রাফিক আইন মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা রাস্তা পার হবেন, ইতিমধ্যে জেব্রা ক্রসিং করা, আন্ডার পাস করার যেখানে জায়গা আছে করে দেওয়া, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, সব করে যাচ্ছি। তারপরও বলব আমাদের দেশের মানুষের একটু সচেতন হওয়া উচিত।

“এই যে হঠাৎ দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হতে যাওয়া, ছোট শিশুকে নিয়ে পার হতে যাওয়া বা দুটি বাস দাঁড়িয়ে আছে, যে কোনো সময় বাস ছাড়তে পারে, দেখা গেল ফাঁক দিয়ে বেরুতে গিয়ে, বাস ড্রাইভারের পক্ষে তো দেখা সম্ভব না। যখন গাড়ি চলে গেল সাথে সাথে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেল। অথবা গাড়িতে বসার সময় জানালায় হাত ঝুলিয়ে রাখা, বা মাথা বের করে রাখা। আরেকটা গাড়ি ধাক্কা মারতেই পারে। যেকোনো সমস্যা হতে পারে, তখন ড্রাইভারকে দোষ দেবেন কী করে?”

গণপরিবহন ব্যবহারেও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।

“গাড়িতে থেকে নামতেও তাদের একটু সচেতন হওয়া প্রয়োজন আছে। তাদেরও ট্রাফিক রুলটা মেনে চলা উচিত। ড্রাইভারের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে সেটা বলেন? এভাবে যদি যেখানে সেখানে রাস্তা পার হয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই এটা থামবে। নাহলে থামবে না।”

প্রধানমন্ত্রী তার লিখিত প্রশ্নের জবাবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নিরাপদ সড়ক আইন প্রণয়ন কার্যক্রম গ্রহণ, শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ৫টি বাস প্রদান, কলেজের সামনে জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ ও আন্ডারপাস নির্মাণ কাজের উদ্বোধন, রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ ও সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ২টি আন্ডারপাস নির্মাণের নির্দেশনা, কারওয়ান বাজার ও গুলিস্তান আন্ডারপাসে লাইটিং ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কে স্পিড ব্রেকার ও জেব্রা ক্রসিং নির্মাণ, ছাত্র-ছাত্রীদের রাস্তা পারাপারে স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ মোতায়েনসহ নানা উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে চার বছর মেয়াদী ন্যাশনাল রোড সেফটি অ্যাকশন প্লান (২০১৭-২০২০) প্রণয়ন, একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানোর নির্দেশনা, দুরপাল্লার বাসে দুইজন চালক রাখা, হাইওয়ের পাশে বিশ্রামাগার স্থাপনসহ আরো কিছু উদ্যোগের কথাও বলেন।

সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমানোসহ বেশ কিছু পরিকল্পনার কথা জানান।

স্কুলশিক্ষার্থী সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে ফুটব্রিজের নিচ থেকে রাস্তা পার হচ্ছেন এক ব্যক্তি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ থেকে তোলা ছবি। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এর অংশ হিসেবে ৩৭৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা, ৩৯৪ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের উভয় দিকে সার্ভিস লেনসহ চার লেনে উন্নীতকরণ, ১২১টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থানে প্রতিকারমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ, অতিরিক্ত ওজনের যানবাহন নিয়ন্ত্রনে অ্যাক্সল লোড কন্ট্রোল স্টেশন নির্মাণ, ২২টি সড়কে নছিমন, করিমনসহ ত্রি-হুইলার নিষিদ্ধ, মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসে সর্বোচ্চ ৮০ কিমি ও ট্রাকের ৬০ কিমি গতিসীমা নির্ধারণসহ বেশ কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।

ঢাকা শহরের যানজট নিয়ে স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজীর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে বসবাসের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “পৃথিবীর বড় বড় শহরে এই সমস্যা সব জায়গায়ই আছে। সব দেশের রাজধানীতেই যানজটের সমস্যা রয়েছে। ঊনসত্তর সালে যখন লন্ডনে ছিলাম তখনও এই যানজটের সমস্যা। আশিতে যখন ছিলাম তখনও এই সমস্যা। এখনো গেলে সমস্যা। কোনো অনুষ্ঠানে যেতে ৩ ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বের হতে হত। ঢাকায় এটা নিরসনের চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

ঢাকার যানজট সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা আরো বলেন, “মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি যত হচ্ছে তারা তত বেশি গাড়ি ব্যবহার করছেন। আর যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। আগে যে পরিবারের একটিও গাড়ি ছিল না, এখন তাদের মধ্যে কোনো কোনো পরিবার দুটো গাড়িও চালাচ্ছে।

“যার একখানা গাড়ি ছিল তার এখন তিনখানা গাড়ি। আর আমাদের দেশে গাড়ি চালায় কিন্তু চালকেরা। কেউ সেলফ ড্রাইভিং না। ফলে গাড়ি রাস্তায় অনবরত ঘুরতে থাকে। আর যানজট লেগেই থাকে। যানজট যেমন সমস্যা, তেমনি যানজট কিন্তু এটাও বোঝায় যে বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নত হচ্ছে। তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়ছে এবং তারা গাড়ি ব্যবহার করতে পারছে।”