গুজব সনাক্তে কেন্দ্র স্থাপনের ভাবনা

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গুজব ছড়ানোর  প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচনের আগে ইন্টারনেটে ‘অপপ্রচার’ বন্ধে ‘গুজব সনাক্তকরণ ও নিরসন কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Sept 2018, 12:33 PM
Updated : 11 Sept 2018, 12:57 PM

আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানিয়েছেন।

সোশাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ করে গুজব চিহ্নিত করতে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তথ্য অধিদপ্তরকে একটি ‘ইমিডেয়েট রেসপন্স ওয়ার্কিং টিম’ গঠনের নির্দেশেনা দিয়েছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।

রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে মঙ্গলবার ‘গুজব : গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় একথা জানানো হয়।

সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীরা এই মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে গুজব থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেন।

পাশাপাশি কোনো ঘটনা ঘটার পর সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত প্রকৃত ঘটনা বা তথ্য গণমাধ্যমকর্মীদের সরবরাহের দাবিও জানান সাংবাদিকরা।

সবার বক্তব্য শুনে তথ্যমন্ত্রী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার আগেও গুজব রটনার অপসংস্কৃতি ছিল। সাম্প্রতিককালে ইন্টারনেটে সামাজিক গণমাধ্যম আসার পরে বিষয়টি ফের নজরে এসেছে।

“সাধারণ অপরাধী, ব্ল্যাকমেইলর, বিদেশি চর ও মহল গুজব রটায়। অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তারাও ‍গুজবকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। রাজনৈতিক মহল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুজব রটনা এবং মিথ্যাচার করে থাকে।”

সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি মহল ক্রমাগত ধর্মের অপব্যাখ্যা করে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে জানিয়ে ইনু বলেন, “যারা সাম্প্রদায়িক বোমার মালিক, তারা গুজব বোমা ফাটায় ও গুজব বোমার জন্ম দেয়। যারা ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে, তারাই গুজবের জন্ম দেয়।

“রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে মিথ্যাচার হচ্ছে। গুজব রটনা ও মিথ্যাচারের প্রধান কারখানা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গি চক্র। প্রকাশ্যেই আমি এই অভিযোগ দিচ্ছি এবং তথ্য দিয়ে তা প্রমাণ করব।”

জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং কোরআনের বাণী নিয়ে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। সম্প্রদায়িক-জঙ্গিচক্রের কালা থাবা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে রক্ষা করতে হবে।

“নিজেদের রক্ষা করতে চাইলে গুজব সনাক্তকরণ ও নিরসন কেন্দ্র সরকারিভাবে স্থাপন করা দরকার। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করব কীভাবে এটাকে দ্রুত সফল করা যায়।”

গুজব চিহ্নিতের পাশাপাশি সঠিত তথ্যের প্রবাহ অব্যাহত রাখার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে বলে মত দেন তথ্যমন্ত্রী ইনু।

তিনি বলেন, কীভাবে ফেইসবুকে গুজবকে জনগণ মোকাবেলা করবে সেজন্য জনগণকে ডিজিটাল শিক্ষা দিতে হবে। এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে, মূলধারার গণমাধ্যম এখানে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে।

গুজব ছড়ানোর সুস্পষ্ট অভিযোগে কয়েকজন গ্রেপ্তার করা হলেও তাদের পক্ষে কেউ কেউ অবস্থান নেওয়ার তার কঠোর সমালোচনা করেন তথ্যমন্ত্রী।

“গুজব রটনাকারীদের চিহ্নিত করতে যখন পদক্ষেপ গ্রহণ করি তখন একটা মহল বলে ‘গণতন্ত্র গেল, বাকস্বাধীনতা গেল’ হৈ চৈ শুরু করে। ফলে গুজব রটনাকারী ও মিথ্যাচারের আশ্রয় যারা নেন তারা রেহাই পেয়ে যায়। এবং দেশে একটা বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয় ফলে গুজব রটনাকারীরা রেহাই পায়।”

তথ্যমন্ত্রী বলেন, ফেইসবুকসহ সামাজিক গণমাধ্যমের পবিত্রতা যদি রক্ষা করতে চান তাহলে গুজব রটনাকারীদের কালো ধোঁয়া থেকে রক্ষা করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। এটা গণতন্ত্রের বিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ না।

“একটা গুজব রটনাকারী ও মিথ্যাচারের মোকাবেলা করার জন্য প্রযুক্তিগত ছাঁকনি, সাইবার অপরাধ দমন আইন এবং সম্প্রচার আইন দরকার। … প্রযুক্তিগত ছাঁকনি ব্যবহার করে অনভিপ্রেত বিষয় আটকাতে পারব। যারা বেনামে পোস্ট দেয় তাদের কঠোরভাবে বাতিল করে দিতে হবে।”

ইনুর ভাষ্য, “ফেইসবুকে যারা বেনামে পোস্ট দেয়, তারা দেশে শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, গণমাধ্যমে শত্রু। নাম গোপন করা যত আইডি আছে, তা বাতিল করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

“মনে ছাঁকনি বসাতে হবে, মনের ছাঁকনি দিয়ে সত্য-মিথ্যা যাচাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। আর প্রযুক্তির ছাঁকনি দিয়ে অনভিপ্রেত বিষয়কে আটকানোর ব্যবস্থা করুন। এসব পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।”

সাম্প্রতিকালে কিছু গুজব ও মিথ্যাচার রটনার ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে সন্দেহ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। উনার দণ্ড নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে, আদালত সম্পর্কে ভুয়া প্রচারণা করা হচ্ছে। কিন্তু আদালত প্রকাশ্য।

“রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য, পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করার জন্য খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে গুজব রটানো হচ্ছে।”

নির্বাচন সম্পর্কে একটা সন্দেহ তৈরিরও চেষ্টা চলার বিষয়টি তুলে তিনি বলেন, “আপনি গ্রাম-গঞ্জে যাবেন, সবাই প্রশ্ন করবে- নির্বাচন কী হবে? …নির্বাচন সম্পর্কে একটা সন্দেহের ফানুস বাংলাদেশে তৈরির চেষ্টা করছে, যা দেশে শান্তিকালীন শূন্যতা তৈরি করতে পারে, এটা ভয়াবহ একটা খারাপ কাজ।

‘গুজব থেকে কেউ নিরাপদ নই’ মন্তব্য করে তারানা হালিম বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যেমন অনিরাপদ আপনারাও (গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান) কেউ নিরাপদ নন, আপনাদের লোগো ব্যবহার করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য অপকর্মগুলো হচ্ছে।

“আমি মনে ইমিডেয়েট রেসপন্স ওয়ার্কিং টিম গঠন করা প্রয়োজন। এটা আগেই নির্দেশনা ছিল, আমি পিআইডিকে অনুরোধ করব আগামী ১৫ দিনের একটা কাগজ অন্তত টেবিলে চাই যে এটি ২৪ ঘণ্টায় তিনটি ভাগে বিভক্তে হয়ে কাজ করবে এবং তারা সব স্যোশাল মিডিয়া দেখে যাচাই করবে এবং তার একটি রিপোর্ট আপনারা ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে যেন পান এটা গুজব।”

জামায়াত-শিবির তিনশরও বেশি ফেইসবুক পেইজ পরিচালনার পাশাপাশি সেগুলোতে অর্থায়ন করছে বলেও দাবি করেন তারানা।

প্রধান তথ্য কর্মকর্তা কামরুন নাহারের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, তথ্য সচিব আবদুল মালেক ছাড়াও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তারা গুজব নিয়ে নিজেদের মত তুলে ধরেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে বলেন, গুজবের বিষয়ে দেশে কোনো ধরনের গবেষণা হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে বেশ কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরে এই অধ্যাপক গুজব থেকে রক্ষার কিছু কৌশল সম্পর্কে বক্তব্য দেন।