কারাগারে আদালত: প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ চান খালেদার আইনজীবীরা

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিচারের জন্য কারাগারে যেভাবে আদালতের এজলাস বসানো হয়েছে এবং ‘অসুস্থ থাকার পরও’ যেভাবে তার বিচার চলছে- সে বিষয়ে আপত্তি জানাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছেন তার জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2018, 08:44 AM
Updated : 9 Sept 2018, 02:41 PM

‘বিচারিক সীমা লঙ্ঘনকারীদের’ বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে একটি লিখিত আবেদনও করেছেন তারা।

এদিকে দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে এবং তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ‘বিশেষ বোর্ড’ গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহবুব উদ্দীন খোকন সাংবাদিকদের বলেন, “ইউনাইটেড বা বিশেষায়িত হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আবেদনটি করা হয়েছে। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি সোহেল আহমেদের হাই কোর্ট বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসতে পারে “

বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একটি বোর্ড গঠনের পাশাপাশি তার চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় নথি দাখিলের নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে রিট আবেদনে।

স্বরাষ্ট্রসচিব, আইজি (প্রিজনস), ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপারসহ সাতজনকে বিবাদী করে দায়ের করা রিটে ‘খালেদা জিয়ার যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- সেই মর্মে রুল চাওয়া হয়েছে।

এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী দলের সদস্য খন্দকার মাহবুব হোসেন, জমিরউদ্দিন সরকার, এ জে মোহাম্মদ আলী, জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকন, মীর নাসির উদ্দীন এবং বদরুদ্দোজা বাদল রোববার দুপুরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কক্ষে গিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা কথা বলেন।

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যগত বিষয় এবং জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে একটি লিখিত আবেদনও তারা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতিকে দেন।

ওই লিখিত আবেদনে মূলত পাঁচটি যুক্তি তুলে ধরেছেন বিএনপিনেত্রীর আইনজীবীরা।

# মাসদার হোসেন মামলার রায় এবং সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগ স্বাধীন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অবশ্যই আগে সুপ্রিম কোর্টের মতামত ও পরামর্শ নিতে হবে। কিন্তু ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করা হয়নি, অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। এতে মাসদার হোসেন মামলার রায়ে এবং সংবিধানে স্বীকৃত সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।

# এছাড়া সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধঃস্তন সকল আদালতের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা হাই কোর্ট বিভাগের উপর ন্যস্ত থাকার পরও উচ্চ আদালতের অনুমোদন ছাড়া আদালত স্থানান্তর বেআইনি এবং আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। এটি করে উচ্চ আদালতের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।

# সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন ছাড়া আদালত স্থানান্তর সংক্রান্ত গেজেট জারি ও তা কার্যকরের কোনো সুযোগ নেই। যদি করা হয়, তবে তা হবে সম্পূর্ণ কায়েমী স্বার্থে।

# খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তিনি হাঁটতে পারছেন না, যা সরকারও স্বীকার করেছে। কিন্তু তারপরও সংশ্লিষ্ট আদালত তার পছন্দমত চিকিৎসক দিয়ে তার সুচিকিৎসার জন্য কোনো উদ্যোগ নেননি।

# দেশের কারাগারের তালিকা থেকে পরিত্যক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটি এখনও বাদ দেওয়া হয়ননি। কিন্তু সুপ্রিম কার্টের অনুমতি ছাড়াই ওই কারাগারে আদালত স্থানান্তর করা হয়েছে। এটি বেআইনি এবং এটি করতে যে গেজেট জারি করা হয়েছে সেটি আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত।

লিখিত আবেদনে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে বলা হয়েছে, “আমরা আপনার কাছে অনুরোধ করছি, যারা বিচারিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং এই বিচারিক ক্ষমতা অপব্যবহারে যে বিচারিক কর্মকর্তা তার বিচাররিক সীমা লঙ্ঘন করেছেন- তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট বাংলদেশ (হাই কোর্ট বিভাগ) ১৯৭৩ বিধি অনুযায়ী তদন্ত করে বিচার বিভাগকে রক্ষার সার্থে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।” 

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, “হঠাৎ করে রাতের বেলা নিয়ম বহির্ভূতভাবে, আইন বহির্ভূতভাবে জেলখানার একটি কক্ষকে কারাগার হিসেবে পরিগণিত করে একটি অস্থায়ী আদালত স্থাপন করা হয়েছে। আপনারা দেখেছেন, গত তারিখে অসুস্থ অবস্থায় বলতে গেলে জোর করে তাকে সেই আদালতে হাজির করা হয়েছে।”

জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়া গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি।

‘অসুস্থতার কারণে’ গত সাত মাসে তাকে একবারও আদালতে হাজির করা সম্ভব না হওয়ায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলার শুনানি শেষ করতে কারাগারের ভেতরেই আদালত বসিয়ে বিচারের ব্যবস্থা করেছে সরকার।

এর বিরোধিতা করে বিএনপি এই বিচারকে ‘ইন ক্যামেরা ট্রায়াল’ ও ‘সংবিধান পরিপন্থি’ আখ্যায়িত করেছে। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, তাদের ‘অসুস্থ নেত্রীকে জোর করে’ ওই আদালতে হাজির করা হয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোর্ট যেখানে খুশি হতে পারে, এখানে সংবিধান পরিপন্থি কিছু নেই।

বিএনপির ভাইস জেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন অভিযোগ করেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টা আগে জুডিশিয়াল আদেশ দিয়ে আইনজীবীদের জানানোর কথা থাকলেও এক্ষেত্রে তা করা হয়নি।

“যেহেতু এটা ওপেন ট্রায়াল না, সে কারণে আমরা সেখানে (স্থানান্তরিত আদালতে) উপস্থিত হতে পারি নাই। সে কারণে ওই আদালত আবার ১২ সেপ্টেম্বর তারিখ দিয়েছেন।”

ওই আবেদনের বিষয়ে প্রধান বিচারপতি কী বলেছেন জানতে চাইলে জয়নুল বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, রাতের অন্ধকারে এই রকম একটি আদালত স্থানান্তরের জন্য গেজেট করতে প্রধান বিচারপতি অনুমতি দেন নাই। প্রধান বিচারপতি ধৈর্য্যের সঙ্গে কথা শুনেছেন এবং আমাদের আবেদন গ্রহণ করেছেন। আমরা আশাবাদী, তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন।

“তিনি বলেছেন, তিনি এটা দেখবেন। বলেছেন, তার ক্ষমতাবলে, মাসদার হোসেন মামলার আলোকে যেটুকু ক্ষমতা তার আছে, সে অনুযায়ী তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন।”

খালেদার আইনজীবীরা আইন জানেন না: আইনমন্ত্রী

এদিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সাক্ষাতের পরপরই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

প্রায় এক ঘণ্টার সাক্ষাতের পর বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ঈদের পর সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছিলাম। পারিবারিক কারণে এতদিন দেখা করতে পারিনি। আজকে মনে করলাম যে ঈদের সাক্ষাত করা দরকার।”

আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আনিসুল হক বলেন, “আমি মনে করি যে, উনারা যদি এরকম কথা বলে থাকেন, তাহলে আমি বলব, উনারা আইন জানেন না।”