সমস্যাটা রাজনীতিতেই: কাদের

সড়কে শৃঙ্খলা আনতে না পারার জন্য দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিকদেরই দায়ী করেছেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যিনি ক্ষমতাসীন দলেরও সাধারণ সম্পাদক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2018, 04:18 PM
Updated : 4 Sept 2018, 04:29 PM

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক মতবিনিময় সভা শেষে মন্ত্রী বলেন, “আমাদের পলিটিক্সটা যদি পুরোপুরি ঠিক হত, তাহলে বাংলাদেশের সব সেক্টর ঠিক রাখা যেত। এখানে আমাদের মূল সমস্যা।”

বাসের চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের মুখে নানা পদক্ষেপ সরকার নিলেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না, যার জন্য মন্ত্রী হিসেবে কাদেরও রয়েছেন সমালোচনায়।

দুর্ঘটনার খবরে নিজের বেদনার্ত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, “রাতে টিভি স্ক্রলে দুর্ঘটনার খবর দেখে সকালে আর পত্রিকা পড়ি না। পরে পড়ি। মনের উপর প্রতিক্রিয়া হয়, মন্ত্রী কি মানুষ নয়? এগুলো কি আমাকে আলোড়িত করে না? আমার জীবনে কি এসবের প্রতিক্রিয়া নেই?

“প্রতিদিন এত লোক মারা যাচ্ছে কেন? ছোট ছোট ব্যাটারিচালিত রিকশা, এ নগরীতে চলছে নতুন উপদ্রব; তারপর মোটর সাইকেল… কয়েকদিন আগে দেখলাম ১০ জন মারা গেছে। তারা সবাই মোটরসাইকেল চালক।”

মহাসড়কে দুর্ঘটনার জন্য ব্যাটারিচালিত ছোট অবৈধ যানগুলোকে দায়ী করলেও সেগুলোকে তুলতে না পারার জন্য রাজনীতিকদের দায়ী করেন মন্ত্রী।

“দেশে কয়েকশ ইজিবাইক কারখানা আছে; উৎসমুখ বন্ধ করতে পারিনি। চিঠি দিয়েছি, কথা বলেছি, মিটিংও করেছি, কিন্তু বাস্তবায়ন জিরো। মাঝে মাঝে অসহায় বোধ করি এ রকম কেন হয়।”

ইজিবাইক ২২টি সড়কে পুরোপুরি বন্ধ করতে পারলেও পুরোপুরি সফল হতে না পারার জন্য রাজনীতিকদের দায়ী করে তিনি বলেন, ““অন্যান্য  (সড়কে) সরানো যেত, আমরা যদি জনপ্রতিনিধিরা… আমাদের দেশের অনেক পলিটিশিয়ান এসবের পেছনে আছে। তারা পেছনে থেকে মদদ দেন।”

সড়কে শৃঙ্খলা অমান্যেও রাজনীতিকরা এগিয়ে বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক।

“আপনি দেখুন, ঢাকা শহরে পুলিশকে নিয়ে দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর সবাই এখন হেলমেট পরে চলে। … যখন দেখবেন হেলমেট নেই, এরা পলিটিশিয়ান, এরা হচ্ছে রাজনীতির লোক। দে ডোন্ট কেয়ার। আমি এজন্য বলি, আমরা পলিটিক্সটাতে যদি শৃঙ্খলা ফেরাতে পারি সব জায়গায় শৃঙ্খলা ইজি হয়ে যায়।”

পথচারীরা যদি সড়কে আইন না মানে, তাহলে শুধু চালকদের মানিয়েও কাজ হবে না বলে মনে করেন মন্ত্রী।

“ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডিভাইডার দিয়ে কী হবে? উল্টা দিকে গ্যাপ থাকলে মা তার বাচ্চা নিয়ে লাফ দেয়। কেউ কথা শোনে না। ঢাকা সিটিতে কেউ নিয়ম কানুন মানে না। রেইকলেস চালকের সাথে রেইকলেস পথচারীরাও দায়ী।”

নিয়ম না মানার মানসিকতার পরিবর্তন না হলে মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু কিংবা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তার সুফল পাওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা শহরে পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে কাদের বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বে সমৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় আছে। তার সঙ্গে ঢাকা শহরের চিত্র.. এটা যে কী ভয়ঙ্কর!

“এত গরিব গরিব চেহারা, ছাল-বাকল উঠে গেছে, মা-বাবার দোয়া, আল্লার নামে চলিলাম; চলিতে চলিতে পদচারীর গায়ের উপর… এই তো অবস্থা হচ্ছে।”

ঢাকা শহরেরসহ দেশের অনেক সড়ক নিজের মন্ত্রণালয়ের অধীন না হলেও তার জন্য সমালোচনা শুনতে হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী।

অনেক হতাশা প্রকাশের পরও মন্ত্রী হিসেবে নিজের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করে তিনি বলেন,  “আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি, শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব, যতক্ষণ আমার হাতে দায়িত্ব আছে।”

সভায় লেখক-কলামনিস্ট আবুল মকসুদ বলেন, মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত সড়ক পরিবহন আইনটি পুনঃবিবেচনা করার পরামর্শ দেন।

“সেখানে অনেক ফাঁকফোকর আছে। সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। গত দুই বছরে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা কেন বাস্তবায়ন হয়নি, তা পর্যালোচনার নির্দেশ দেওয়া উচিত।”

বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন,  “ঢাকা শহরে গণপরিবহনে কোম্পানি করতে হবে, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পারার একটি কারণ প্রতিযোগিতা। ঢাকায় বৈধ পার্কিং স্থান, গণপরিবহনে হাইড্রলিক ডোর, রিকশায় লুকিং গ্লাস রাখতে হবে।”

নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “লাইসেন্সধারী চালকরা ওভারটেকসহ আইন অমান্যের কারণে দুর্ঘটনা ঘটালে ১০ বছরের জেল দেওয়ার কথা বলছি।

“জানার পরও ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে দুর্ঘটনা ঘটানো কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া বা ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী চালক দুর্ঘটনা ঘটালে ৩০২ ধারার মামলার বিধান রাখার জন্য বলছি আমরা। এখানে ইনটেনশন আছে, জেনেশুনেই এটা করা হচ্ছে।”

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “খসড়া আইনে বলা হয়েছে, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের শাস্তি দুই বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। কিন্তু যার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তার ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা।

“ধরা পড়লে তো ফেইক লাইসেন্সধারী বলবে তার লাইসেন্স নেই। আমরা দুটি ক্ষেত্রেই দুই বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখতে হবে।”

সভায় আরও বক্তব্য রাখেন স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি রুস্তম আলীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

সবার কথা শুনে আইনের প্রসঙ্গে কাদের বলেন, “কিশোর-কিশোরী যারা নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করেছে, তাদের স্যালুট করি। তারা আন্দোলন করেছে বলেই আইনটা যেভাবেই হোক আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে।

“কিছু কিছু জায়গায় সংশোধনের সুযোগ আছে; সংসদে বিস্তারিত আলোচনা হবে। হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশের মানুষের জন্য আইন যদি যুক্তিযুক্ত না হয় তাহলে আইন এর সুফল দেবে না।”

সংসদের এই অধিবেশনেই আইন পাসের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন,  “আমরা এ অধিবেশনে আইনটা পাস করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটাই শেষ অধিবেশন। আমি আশাবাদী।”

কয়েকজন আলোচক মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলে তার আরও ‘প্রমোশন’ হবে।

জবাবে কাদের বলেন, “আমার প্রমোশনের জায়গায় সিল মারা হয়ে গেছে, এটা আর সামনে যাবে না। সর্বোচ্চ সম্মানের জায়গায় আছি। আর কী চাই? আল্লাহ অনেক সম্মান আর উচ্চতা দিয়েছে। এরপর যে কয়দিন আছি মানুষের কাছে কমিটমেন্ট দিয়ে কাজ করতে পারি, দোয়া করবেন।”