ইভিএম তুমি কার?

নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব প্রোটোটাইপে দুই বছর আগে তৈরি করা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) স্থানীয় সরকারের কয়েকটি নির্বাচনে এরইমধ্যে ব্যবহার করা হলেও এর মেধাস্বত্ব চূড়ান্ত না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে খোদ কমিশনের মধ্যেই।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2018, 04:05 PM
Updated : 1 Sept 2018, 03:40 AM

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের ইসির একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রশ্ন তুলেছেন- ডিজিটাল এই যন্ত্রের উৎস কী, এটা উদ্ভাবন করেছেন কে? কোত্থেকে আমদানি করা হচ্ছে ইভিএমের যন্ত্রাংশ?

স্বত্বের প্রশ্নের সমাধান না করেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কিনতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে ফেলেছেন।

ইসির বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা বলছেন, এই ইভিএমে ভোটারের আঙ্গুলের ছাপ অথবা জাতীয় পরিচিতি নম্বর ব্যবহার করে ভোট দিতে হয় বলে ‘সব ধরনের অনিয়ম’ ঠেকানো সম্ভব। আর ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে ইসির হাতেই এর মেধাস্বত্ব রাখা উচিৎ। 

ইসির বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. হায়দার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন ইভিএমর মেধাস্বত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। মেধাস্বত্ব নিজেদের থাকা মানে এর সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যারসহ ইভিএমে যত টেকনোলজি ইউজ হয়েছে, তার মালিক হবে নির্বাচন কমিশন।”

২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের (বুয়েট) নকশা ও কারিগরি নির্মাণে দেশে ইভিএমের যাত্রা শুরু হয়। সহায়তায় ছিল সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। তবে সেই ইভিএমের ডিজাইন ও মেধাস্বত্ব বুয়েটের হাতেই ছিল।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে ভোট নেওয়ার মধ্য দিয়ে আট বছর আগে যাত্রা শুরু হয় ওই ইভিএমের। এরপর নারায়ণগঞ্জে এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রে এবং কুমিল্লা ও নরসিংদীতে সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হয়।

২০১৩ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যবহৃত পুরনো ইভিএম

২০১২ সালে রংপুরে নির্বাচনে ইভিএমে কারিগরি বিপত্তি দেখা দেওয়ার পর বুয়েট ও ইসির মধ্যে দ্ব্ন্দ্ব তৈরি হয়। পরের বছর রাজশাহী নির্বাচনে ইভিএম চালাতে গিয়ে আবারও সমস্যা দেখা দিলে ইসির বিরুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে বুয়েট।

সে সময় বুয়েটের পক্ষ থেকে বলা হয়, এসব যন্ত্রে আমদানি করা চীনা ব্যাটারি ব্যবহারের কথা থাকলেও ইসি তার বদলে ব্যবহার করেছে ‘দেশি ব্যাটারি’। বুয়েট ওই ইভিএমের ডিজাইন ও মেধাস্বত্বের একমাত্র অধিকারী হওয়ার পরও তাদের পরামর্শ ইসি মানেনি। 

এ নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি চিঠি চালাচালির এক পর্যায়ে সেই ইভিএম অধ্যায়ের ইতি ঘটে।

প্রায় পাঁচ বছর পর, ২০১৭ সালে ইসির নিজস্ব প্রোটোটাইপে বাংলাদেশ মেশিন টুল ফ্যাক্টরিতে (বিএমটিএফ) বানানো যন্ত্রে রংপুর সিটির একটি কেন্দ্রে ভোট নেওয়ার মাধ্যমে ফিরে আসে ইভিএম।

আগের ইভিএমে মেধাস্বত্বের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে ‘অবগত নন’ জানিয়ে অধ্যাপক হায়দার আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগের বিষয়টি আমি জানি না।… ফিঙ্গার প্রিন্টসহ নতুন যে ইভিএম হচ্ছে তার মেধাস্বত্ব আসলে ইসির হওয়া উচিত।”

তবে এ নিয়ে এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি এবং কোনো গেজেটও প্রকাশ করা হয়নি বলে জানান তিনি।

ইসির বিশেষজ্ঞ কারিগরি কমিটির এই সদস্য বলেন, “মাস দুয়েক আগে কারিগরি কমিটির সভায় এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এ নিয়ে বিএমটিএফ ও ইসির পক্ষ থেকে সবাই একমত হয়েছেন- এর মেধাস্বত্ব থাকতে হবে ইসির নামে।”

চলতি বছর গাজীপুর সিটির ভোটে ব্যবহার করা হয় এই নতুন ইভিএম

বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রাংশ দিয়ে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে ইভিএম তৈরির ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব নিয়ে নতুন করে জটিলতা হবে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক হায়দার আলী বলেন, “আমরা রিকোয়েস্ট করেছি এটার মেধাস্বত্ব হবে ইলেকশন কমিশন। তাহলে ইসি আজকে বিএমটিএফ, কালকে অন্য কোনো কোম্পানিকে দিয়েও মেশিন বানিয়ে নিতে পারবে।

“কিন্তু মেধাস্বত্বের মালিক যদি বিএমটিএফ হয়, তখন তারা ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কিনতে গেলে তাদের অনুমতি নিতে হবে।”

ইসির কারিগরি কমিটির আহ্বায়ক ও নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন ইভিএমের মেধাস্বত্ব নির্বাচন কমিশনেরই থাকবে। এর সফটওয়্যার, সোর্সকোড বা অন্য কিছু এখানে করা হচ্ছে। আসলে এটা এখানেই ডেভেলপ করা হয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রাংশ দিয়ে সেই নকশায় বিএমটিএফ ইভিএম তৈরি করে দেবে।”

অবশ্য নতুন ইভিএমের স্বত্বের অন্য কোনো দাবিদার রয়েছে কি না- তা জানেন না নির্বাচন কমিশনের এই কর্মকর্তা।

এ প্রশ্নে ইসির আইসিটি অপারেশন্স অধিশাখার সিনিয়র মেনটেইনেন্স ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিএমটিএফ এখনও ইভিএমের স্বত্ব দাবি করেনি। আগামীতে বিএমটিএফ-এর সঙ্গে সরবরাহ চুক্তি করার সময় বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হবে।

আরও খবর