ইভিএম নিয়ে আপত্তি, মাহবুব তালুকদারের সভা বর্জন

একাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরুর দুই মাস আগে নির্বাচন কমিশন যখন সব প্রস্তুতি গুছিয়ে আনছে, তখন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে আইন সংস্কারের উদ্যোগে ভিন্নমত পোষণ করেছেন খোদ একজন নির্বাচন কমিশনার।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2018, 06:57 AM
Updated : 30 August 2018, 06:57 AM

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন নিয়ে বৃহস্পতিবার কমিশন সভা শুরুর আধা ঘণ্টার মাথায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সভা বর্জন করে বেরিয়ে আসেন এবং পরে কর্মচারীর মাধ্যমে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পাঠিয়ে দেন। 

সেখানে তিনি লিখেছেন, “আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি।”

এই আপত্তির কারণ হিসেবে ইভিএম নিয়ে ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধিতা’ এবং ‘দক্ষ জনবলের অভাব’ এর কথা বলা হয়েছে ওই নোট অব ডিসেন্টে।

গতবছর ফেব্রুয়ারিতে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এ পর্যন্ত অন্তত তিনটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। 

কমিশন সভা বর্জনের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মাহবুব তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এখন আমার অফিসে আছি। আপাতত এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।”

তার একান্ত সচিব মুহাম্মদ এনাম উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্যার বিকাল ৩টায় এ বিষয়ে কথা বলবেন।”

আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে নূরুল হুদার কমিশনের আয়োজনেই একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। সেই সময় ঘনিয়ে আসায় আপাতত আর আরপিও সংস্কার করা হচ্ছে না বলেই জানিয়েছিলেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।

কিন্তু কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের তোড়জোড় শুরু হয়। দেড় লাখ ইভিএম কিনতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও ইসি করামকর্তারা তৈরি করেন।

আরপিও সংশোধন নিয়ে গত ২৬ অগাস্ট কমিশনের প্রথম দফা বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। সেই মুলতবি বৈঠক শুরু হয় বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর।

নির্বাচন ভবনে সিইসির সভাকক্ষে ওই সভায় কমিশনের পাঁচ সদস্যের পাশাপাশি কমিশন সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সভা থেকে বেরিয়ে পঞ্চম তলায় নিজের কক্ষে চলে যান। পরে এক কর্মচারীর মাধ্যমে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পাঠিয়ে দেন কমিশনের কাছে। 

সর্বশেষ কমিশন সভার (২৬ অগাস্ট) প্রসঙ্গ টেনে সেখানে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনে ইসি ওই বৈঠকে তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে।

এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় রূপান্তর, যা একজন পরামর্শক তৈরি করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন। আর সর্বশেষ প্রস্তাবটি ছিল- একাদশ সংসদ নির্বাচনে সময় স্বল্পতার কারণে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন।

“কমিশন সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়। যা ৩০ অগাস্ট বৃহস্পতিবারের সভায় আলোচনার জন্য মুলতবি করা হয়।”

মাহবুব তালুকদার বলছেন, “সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই।”

রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ইভিএম নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আর সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরও আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

তিনি লিখেছেন, “শুরুতে স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার হয়েছিল। এজন্যে প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সম্প্রতি ৩৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন মনে জাগে।”

মাহবুব তালুকদার বলছেন, পরিকল্পনা কমিশন এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, তার কারিগরি বিষয় বুয়েট বা অনুরূপ কোনো সংস্থা থেকে যাচাই করা হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এ যন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তা পরীক্ষা করা হয়নি।

আরপিওতে শুধু ইভিএম ব্যবহারের যে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে তা ইতোমধ্যে কমিশন সভায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন এই নির্বাচন কমিশনার। 

তিনি লিখেছেন, “আমি ধারণা করি, জনমত বা সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহৃত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেওয়া সঙ্গত হবে না “

যন্ত্রের অগ্রগতির এ যুগে ইভিএম ব্যবহারের ‘বিরোধী নন’ জানিয়ে মাহবুব তালুকদার বলেছেন, “স্বল্প সময়ে এতো বিশাল জনবলের প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা এবং ভোটারদের অজ্ঞতাপ্রসূত কারণে ইভিএম নিয়ে অনীহাও থাকবে।”

সাম্প্রিতিক সিটি নির্বাচনে কিছু বিশঙ্খলা এবং ইভিএম কেন্দ্র দখলের অভিযোগের কথাও নোট অব ডিসেন্টে তুলে ধরেছেন তিনি।