লাখো রোহিঙ্গার অনিশ্চিত যাত্রার এক বছর

পেছনে জ্বলন্ত গ্রাম আর প্রিয়জনের গুলিবিদ্ধ লাশ রেখে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের লাখো রোহিঙ্গার অনিশ্চিত যাত্রায় নাফ নদীর দুই তীরে ভয়াবহ যে মানবিক সঙ্কটের সূচনা হয়েছিল, অনেক অনিশ্চয়তা নিয়েই তার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে শনিবার।   

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 August 2018, 07:21 PM
Updated : 25 August 2018, 04:05 AM

এই এক বছরে রোহিঙ্গাদের জনস্রোত থিতু হয়েছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে; সারি সারি ঝুপড়ি ঘরে সেখানে গড়ে উঠেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। কিন্তু রোহিঙ্গাদের পুরো একটি প্রজন্মের ভাগ্যাকাশে আলোর দেখা মেলেনি।

এই এক বছরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার; সেজন্য বাংলাদেশের সঙ্গে তারা চুক্তিও করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, নিরাপত্তা আর জীবিকার নিশ্চয়তা এখনও মেলেনি।

মিয়ানমারের বোধিডং থেকে গতবছর সেপ্টেম্বরে পালিয়ে আসা শাফিকুর শফি ছিলেন একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন। তার ছেলের পাশাপাশি নিকট আত্মীয় অনেককে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা, পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর। তারপরও তিনি জন্মভূমিতে ফিরে যেতে চান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারি নাম (নাগরিকত্ব) চাই আমরা। সরকারি নাম না থাকলে কোনো অত্যাচারের বিচার পাওয়া যায় না। আমার একটা পুকুর আছে, ওই পুকুর ফেরত চাই। আমার পরিবার নিয়ে আবার নিজের বাড়িতে নিরাপদে থাকতে চাই।”

রাখাইনের গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মত মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উঠেছে, তার তদন্ত বা বিচারের দাবি এখনও উপেক্ষিত রয়ে গেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রোহিঙ্গা সঙ্কটের এই বর্ষপূর্তিকে চিহ্নিত করেছে বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতায় ‘লজ্জাজনক একটি মাইলফলক’ হিসেবে।

 

রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখতে এই এক বছরে কক্সবাজারে ছুটে গেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব, ভ্যাটিকানের পোপ, বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা। রোহিঙ্গাদের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনে তাদের চোখ ভিজে উঠলেও মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চির অবস্থানের খুব বেশি হেরফের হয়নি।

প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা সোয়া সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের মানুষ আশ্রয় দিয়েছে নিজেদের ক্ষতি মেনে নিয়েই। সেজন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ প্রশংসা পেয়েছে।

আরও বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় এড়াতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জরুরি সহায়তা নিয়ে ছুটে এসেছে দ্রুত। কিন্তু এই বোঝা আর কতদিন বইতে হবে সে প্রশ্নের উত্তর গত এক বছরে মেলেনি।

গতবছরের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কয়েক ডজন নিরাপত্তা চৌকিতে কথিত রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার জবাবে সেনাবাহিনী নির্মম দমন অভিযানে নামলে এই সঙ্কটের সূচনা হয়।

বাপ-দাদার ভিটে-মাটি পেছনে ফেলে প্রাণ হাতে দুর্গম এক যাত্রায় বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। সেই পথে নাফ নদীতে সলিল সমাধি হয় তাদের অনেকের।

মিয়ানমারের ওই অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করে আসছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারের দাবিও ধীরে ধীরে জোরালো হয়ে উঠছে। অন্যদিকে মিয়ানমার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে বরাবরই।   

 

প্রথমে শরণার্থীদের পথ আটকে দিতে চাইলেও সঙ্কটের গভীরতা আচ করতে পেরে পেরে সীমান্ত খুলে দেয় বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের কথায় উঠে আসতে থাকে তাদের ওপর মিয়ানমারের বাহিনীর নির্মমতার চিত্র।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্মী মিলিশিয়াদের ওই অভিযানের কারণে প্রথম চার মাসেই প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। শুরুর সেই জনস্রোত থামলেও চলতি অগাস্ট পর্যন্ত ‘নির্যাতনের শিকার’ হয়ে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসা থামেনি বলে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে।

বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে জরুরি সহায়তা দেওয়ার প্রাথমিক ধকল সামলে ওঠার পর বাংলাদেশ সঙ্কটের সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করলেও প্রথমে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টায় অগ্রসর হয়।

এরপর মধ্যে নভেম্বর মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয় মিয়ানমার। ১৬ জানুয়ারি দুই দেশের মধ্যে হয় প্রত্যাবাসন চুক্তি। ঠিক হয়, দুই বছরের মধ্যে পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ করা হবে।  

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকলেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, গত জানুয়ারির চুক্তির আওতায় তারা শুধু নতুন আসাদেরই ফেরত নেবে।

এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয় শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজও এগিয়ে নেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গত ১১ জুলাই পর্যন্ত  ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনার কথা জানান।

চুক্তি সইয়ের এক মাসের মাথায় প্রথম ধাপের প্রত্যাবাসনের যাচাইবাছাইয়ের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আট হাজার ৩২জনের একটি তালিকা দেওয়া হয় মিয়ানমারকে। কিন্তু মিয়ানমারের অনিহায় বিষয়টি আর না এগোনোয় বাংলাদেশ বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে তৎপর হয়।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে গত ১৩ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে সই করে ইউএনএইচসিআর। পরে মিয়ানমারও জুন মাসে ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির সঙ্গে একই ধরনের চুক্তি করতে সম্মত হওয়ার কথা জানায়।

জাতিসংঘ বলছে, রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে নিজেদের ভূমিতে ফিরতে পারে এবং প্রত্যাবাসন যাতে স্থায়ী হয় তার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সহায়তার বিষয়ে একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ তৈরি করা হবে এই সমঝোতা স্মারকের আওতায়।

এক বছরে প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারলেও হতাশ নন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম; তিনি বলছেন, রাখাইনের দীর্ঘদিনের এ সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে। মূল সমস্যার সমাধান করেই তারা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে চান। 

“অনেকেই বলতে পারেন- এক বছরের মাথায় এখনও পর্যন্ত একজনও গেল না। আমরা যে জিনিসটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমরা তাড়াহুড়ো করে ১০ হাজার, ২০ হাজার বা ৫০ হাজারকে পাঠাতে চাইনি; এখনও পর্যন্ত চাই না। একটি কথা সকলেই বলেন- সাসটেইনেবল রিটার্ন। ৫ জন বা ৫ লাখ মানুষ গেলেও তারা যেন সেখানে সাসটেইন করতে পারেন…।”

 

প্রতিমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে ভিটে-মাটি পাবে, কাজ পাবে, নতুন করে তাদের ওপর আক্রমণ হবে না- এ বিষয়গুলো মিয়ানমার সরকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

“বিশেষ করে জাতিসংঘ যখন এটার মধ্যে ইনভল্ভড; এটা নিশ্চিত না হয়ে উপায় নেই। নিশ্চিত না করেও কোনো উপায় নেই। সেই জায়গা থেকে আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু হবে।”

শরণার্থীদের জন্য মিয়ানমারের প্রস্তুতি দেখতে গত ১১ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে গিয়ে দুটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও ৩০ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতার একটি ট্রানজিট ক্যাম্প পরিদর্শন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী।

সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ‘ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ধারার মধ্যে’ বিপুলসংখ্যক মানুষের ভোগান্তি দেখার কথা জানায় সফররত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল।

ওই সফরের প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের উদ্দেশ্য ছিল এটুকু বোঝা যে কতটা আবহ সেখানে তৈরি হয়েছে। একটা হল ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার, আরেকটি হল সাইকোলজিক্যাল ডিসিমিনেশন বোঝা।”

এর মধ্যে অবকাঠামোগত প্রস্তুতি অনেকটা এগিয়েছে জানিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, “আমাদের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে মিয়ানমারের ওপর বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার চাপ বাড়ার কারণেই তাদের এ পরিবর্তন।”

পশ্চিমা মিত্ররা একসময় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে দেশটির ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ হিসেবে বিবেচনা করলেও রোহিঙ্গাদের ওপর সেনা নিপীড়েন বন্ধে উদ্যোগী না হওয়ায় শান্তিতে নোবেলজয়ী এই নেত্রীকে বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হতে হয়েছে। সেই সঙ্গে নানামুখী আন্তর্জাতিক চাপ সামলাতে হচ্ছে তার সরকারকে।

গত ২ জুলাই রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখে, তাদের মুখ থেকে হত্যা আর ধর্ষণের ভয়াবহ বিবরণ শোনার পর খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও বিশ্বকে ‘ঐক্যবদ্ধ হয়ে’ মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান।  

কিন্তু বাংলাদেশকে উল্টো চাপে রাখার কৌশল (রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন: বাংলাদেশকে উল্টো চাপের কৌশল সু চির) নিয়ে গত মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতায় সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি বাংলাদেশের ওপরই নির্ভর করছে।

সু চির ওই বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বলেছেন, নিজেদের ‘ব্যর্থতা আর প্রস্তুতির অভাবকে চেপে যাওয়ার জন্যই’ হয়ত মিয়ানমারের নেত্রী ওই মন্তব্য করেছেন।

মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোহিঙ্গারা যখন চলে এসেছে তখন তাদেরকে ফেরত পাঠানো বেশ কঠিন। প্রত্যাবাসনের জন্য প্রথম যে কাজটি করতে হবে, সেটি হচ্ছে তাদের সঠিক তালিকা করা। এরপর সেই তালিকা মিয়ানমার যাচাই-বাছাই করলে তারপর হবে প্রত্যাবাসন।

অবশ্য আন্তর্জাতিক রেডক্রসের বাংলাদেশ প্রধান ইখতিয়ার আসলানভ এখনই আশা-হতাশার অংক মেলাতে বসতে রাজি নন। মিয়ানমার ও বাংলাদেশ- দুই দেশেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক এ সংস্থা।    

আসলানভ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবিষ্যত বলে দেবে, কী সম্ভব আর কী সম্ভব না। আজই আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে প্রত্যাবাসন হবে না।”