শহিদুলকে নির্যাতন করা হয়েছে কিনা পরীক্ষার নির্দেশ

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ‘উসকানিমূলক মিথ্যা’ প্রচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে ডিবি হেফাজতে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে কিনা- তা পরীক্ষা করে দেখতে বলেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2018, 11:23 AM
Updated : 9 August 2018, 03:14 PM

বিষয়টি পরীক্ষা করে স্বরাষ্ট্র সচিবকে সোমবারের মধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে।

শহিদুলকে রিমান্ডে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং তাকে হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন জানিয়ে তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদের করা রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেয়।

আদালতে শহিদুল আলমের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সারা হোসেন। এ সময় ড. কামাল হোসেনও ছিলেন তার সঙ্গে। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।

রেহনুমার আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার শহিদুল আলমকে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজত থেকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে শহিদুলের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

সে অনুযায়ী বুধবার সকালে শহিদুলকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া হয় এবং চার সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। বিকালে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল থেকে তাকে আবার গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়। 

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ-আল-হারুন সাংবাদিকদের বলেন, শহিদুলকে ভর্তি করার মত অবস্থা তারা দেখেননি।

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা বৃহস্পতিবার সকালে তাদের প্রতিবেদন হাই কোর্টে জমা দেন।

কিন্তু ওই প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সারা হোসেন শুনানিতে বলেন, “আদালতের নির্দেশনা ছিল শহীদুল আলমের সমস্ত পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে। কিন্তু তারা তার অসুস্থতার পরীক্ষা করেছেন। আদালত তো সে নির্দেশনা দেয়নি।”

সারা বলেন, “নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর ২(৩) ধারায় নির্যাতনের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘নির্যাতন’ অর্থ কষ্ট হয় এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এছাড়া কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য সন্দেহভাজন বা অপরাধী কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দিলে সেটিও নির্যাতন হিসেবে স্বীকৃত। এর বাইরে কোনো ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানো হলে সেটিও নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা হবে।”

একই আইনের ৪ ধারা তুলে ধরে সারা হোসেন বলেন, “আদালতের সামনে কোনো ব্যক্তি যদি অভিযোগ করে যে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে ওই ব্যক্তির বিবৃতি লিপিবদ্ধ করতে হবে, একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দিয়ে তার শারীরিক পরীক্ষার আদেশে দিতে হবে।

“ওই ব্যক্তির শরীরে জখম থাকলে অবশ্যই তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। কিন্তু শহীদুল আলম নির্যাতনের অভিযোগ করার পরও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ বা আদেশ না দিয়ে তাকে সাত দিনের রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে “

এ আইনজীবী বলেন, চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং নাকে ঘুষি মারা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শহিদুল। তারপরও সেসব লিপিবদ্ধ করা হয়নি।

“যে কারণেই আমরা হাই কোর্টে এসেছি। একই সঙ্গে রিমান্ডের আদেশটিও আইনসম্মত হয়নি। রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে আপিল বিভাগের গাইডলাইন রয়েছে। এখানে সেটা অনুসরণ করা হয়নি। যে অভিযোগে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তার সবই জব্দ করেছে পুলিশ। তাই তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আর কোনো যৌক্তিকতা নেই।”

সারা হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের যে চারজন চিকিৎসক শহিদুলকে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাদের কেউ মনোচিকিৎসক বা মনোবিশেষজ্ঞ ছিলেন না।

“তাহলে উনি সম্পূর্ণ ফিট আছেন এটা কীভাবে বলেন? এই প্রতিবেদন দিয়ে যেমন আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে, আদালতের আদেশও অমান্য করা হয়েছে। তার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিষয় পুনঃপরীক্ষা করার আবেদন জানাচ্ছি।”

অন্যদিকে ডিবি হেফাজত থেকে হাসপাতাল স্থানান্তর ও রিমান্ডের আদেশ চ্যালঞ্জ করে শহিদুল আলমের স্ত্রীর করা রিট আবেদনটি ‘যথাযথ হয়নি’ দাবি করে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেন, “আবেদনেই দাবি করা হয়েছে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে শহিদুল আলমের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাহলে রিমান্ড কীভাবে আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত হয়?

“তাছাড়া উনার জামিন আবেদন ওই আদালতে খারিজ করা হলে মহানগর দায়রা জজ আদালতে যাবেন। তা না করে উনারা এসেছেন হাই কোর্টে। এই অবেদনে হেবিয়াস করপাস (উচ্চ আদালতের নির্দেশে আসামিকে হাজির করা) চাওয়া হয়েছে। এ ধরনের আসামির ক্ষেত্রে হেবিয়াস করপাস চাইতে পারেন না।”

শহিদুল আলমকে রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে আইন বহির্ভূত কিছু হয়নি দাবি করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আসামির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে মামলা হয়েছে।

“তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আদেশের ভিত্তিতে তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।”

মামলার এজাহার থেকে উদ্ধৃত করে মাহবুবে আলম বলেন, “শুধুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে না, আল জাজিরা টিভিতেও সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলে অপপ্রচার চালাতে তাকে কে উৎসাহিত করেছে তা বের করার জন্যই তাকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন।”

স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা আদালতে বলেন, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শহিদুল সম্পূর্ণ সুস্থ। আর মোবাইল ফোনে একটি ভিডিও দেখিয়ে বলেন, “দেখুন ডিবি অফিসে শহিদুল আলম কীভাবে হাঁটছেন। ওইখানে তিনি যেভাবে হাঁটছেন তাতে কোনোভাবেই বলা যায় না যে তিনি অসুস্থ।”

সারা হোসেন তখন বলেন, “আমরা এখানে জামিন চাইতে আসিনি। এবং আমরা এটাও বলিনি যে, রিমান্ড আন লফুল অথরিটি হয়েছে, বলেছি রিমান্ডটা আন লফুল ম্যানারে হয়েছে।”

আদেশের পর সারা হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩-এর ২ (৬) ধারা অনুযায়ী শহিদুল আলমকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে সোমবারের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাই কোর্ট।”

এদিকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পাঠিয়ে শহিদুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন দেওয়ার যে আদেশ হাই কোর্ট দিয়েছিল, তা স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি সোমবার পর্যন্ত মুলতবি রেখেছে আপিল বিভাগ।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত ৩ ও ৪ অগাস্ট জিগাতলা এলাকায় সংঘর্ষের বিষয়ে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফেইসবুক লাইভে আসেন অধিকারকর্মী আলোকচিত্রী শহিদুল। ওই আন্দোলনের বিষয়ে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরকারের সমালোচনাও করেন।

এরপর রোববার রাতে শহিদুলকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করে পুলিশ।

ওই মামলায় ‘কল্পনাপ্রসূত তথ্যের’ মাধ্যমে জনসাধারণের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ‘মিথ্যা প্রচার’ চালানো, উসকানিমূলক তথ্য উপস্থাপন, সরকারকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও অকার্যকর’ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘অবনতি ঘটিয়ে’ জনমনে ‘ভীতি ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে’ দেওয়ার ষড়যন্ত্র এবং তা বাস্তবায়নে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ‘অপপ্রচারের’ অভিযোগ আনা হয় আলোকচিত্রী শহিদুলের বিরুদ্ধে।

সোমবার আদালতে তোলার আগে গাড়ি থেকে নামার সময় শহিদুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমাকে আঘাত করা হয়েছে। আমার রক্ত মাখা পাঞ্জাবি ধুয়ে আবার পরানো হয়েছে।”

আর হাকিম আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শহিদুল বলেন, গ্রেপ্তারের সময় তার চোখ-মুখ বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হয়েছিল।

“তারা আমাকে মোসাদ, আইএসআইর এজেন্ট বলে গালি দেয়, দেশদ্রোহীও বলে তারা। তারা আমাকে মারধরও করে।”

৬৩ বছর বয়সী শহিদুলকে হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন জানিয়ে মঙ্গলবার হাই কোর্টে তার স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রেহনুমার করা আবেদনে বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে শহিদুলকে ‘নির্যাতন’ এবং চিকিৎসা না দিয়ে তাকে রিমান্ডে পাঠানোর মাধ্যমে সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৩ এবং ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করা হয়েছে।