রিমান্ডে থাকা শহিদুলকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে আদালতের নির্দেশ

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ‘উসকানিমূলক মিথ্যা’ প্রচারের অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের মামলায় রিমান্ডে থাকা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজত থেকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 August 2018, 10:30 AM
Updated : 9 August 2018, 10:49 AM

সেই সঙ্গে আগামী বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে শহিদুলের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে।

শহিদুলকে রিমান্ডে পাঠানোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং তাকে হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন জানিয়ে তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদের এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এই আদেশ দেয়।

রিট আবেদনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন ও সারা হোসেন। এছাড়া আইনজীবী শাহদীন মালিক, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও তানিম হোসেইন শাওন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।

ড. কামাল শুনানিতে বলেন, শহিদুলকে ‘নির্যাতন’ করা হয়েছে। তার জুরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা না দিয়ে তাকে রিমান্ডে নেওয়ায় সংবিধানের ৩১, ৩২, ৩৩ এবং ৩৫(৫) অনুচ্ছেদকে লঙ্ঘন করা হয়েছে।

“তাছাড়া গ্রেপ্তারের পর ডিবি হেফাজতে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং রিমান্ডে নেওয়ার ব্যাপারে আদালতে কোনো যৌক্তিক কারণ পুলিশ দেখাতে পারেনি। তারপরও রিমান্ডে নেওয়ার আদেশে বিজ্ঞ বিচারক তার বিচারকি মানসিকতার প্রমাণ রাখেননি। ফলে তাকে দ্রুত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে স্থানান্তরের নির্দেশনা চাইছি।”

কামাল হোসেন বলেন, শহিদুল আলম ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ একজন আলোকচিত্রী।

“তার মত একজন ব্যক্তিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন করা হয়েছে।”

শহীদুল আলম (ফাইল ছবি)

শহিদুল আলমকে রিমান্ডে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরের বিষয়ে আপত্তি জানালে বিচারক বলেন, “এসব তো পুলিশের বক্তব্য। আর এখানে তো তার চিকিৎসার বিষয়ে কথা হচ্ছে। অসুস্থ বা আহত হলে তাকে চিকিৎসা দিতে হবে না?”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তখন বলেন, “উনার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট একটি মামলাও হয়েছে। আমি ছোটো আইনজীবী। কোনো রকম আদেশ না দিয়ে শুনানি মুলতবি রাখা হোক। মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল এ বিষয়ে শুনানি করবেন।”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন তখন বলেন, “ছবিতে দেখা গেছে, তিনি হাঁটতে পারছেন না।”

এ পর্যায়ে আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, “আমি ওই কোর্টে উপস্থিত ছিলাম। তিনি নাকে আঘাতপ্রাপ্ত। একদম খালি পায়ে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। উনি হাঁটতে পারেন না। আর আমরা তো অন্য কোনো বিষয়ে এখন আদেশ চাচ্ছি না। দ্রুত চিকিৎসার জন্য আদেশ চাচ্ছি।”

অমিত তালুকদার বলেন, “আগামীকাল মামলার কাগজপত্র আসবে। সেগুলো দেখে আসলে বলা যাবে…।”

বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন বলেন, “বুঝলাম তিনি ( শহিদুল আলম) সাংঘাতিক রকমের কাজ করে ফেলেছেন! কিন্তু তাকে মারপিট করছেন কে? পত্রিকায় দেখালাম তাকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিকরা লিখেছে, তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। আপনারা তাকে পিটাবেন, আর আমরা বসে বসে দেখব?

“যে ব্যক্তি ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন, নির্যাতন না করা হলে তিনি কি মিথ্যা বলেছেন? ধরে নিলাম তিনি ফলস বলেছেন, কিন্তু সাংবাদিকরা যে লিখেছেন তার নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে, সাংবাদিকরা কি মিথ্যা লিখেছে?

“আর নিশ্চই তিনি দুই তলা, তিন তলার ডিগ্রি নেননি! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তাররা দেখুক। আগে দেখি ডাক্তাররা কী বলে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে কি- হয়নি সেটা আমাদের দেখতে হবে।”

সারাহ হোসেন শুনানিতে শহিদুলের রিমান্ড স্থগিতের জন্য যুক্তি দেখানোর সময় বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন বলেন, “আরে রাখেন, ভাগ্য ভালো যে উনাকে গুম করেনি।”

এরপর আদালত বৃহস্পতিবার বিষয়টি আবার শুনানির জন্য রেখে  শহিদুল আলমকে ‘দ্রুত’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে স্থানান্তরের আদেশ দেয়।

আদেশের পর ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “যেহেতু আদালত দ্রুত উনাকে হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা আশা করি, সেই পর্যন্ত তার রিমান্ড স্থগিত থাকবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে এই আইনজীবী বলেন, “ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়ে আমাদের সংবিধানে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। ফলে রিমান্ডের আগে এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে সংবিধানের ৩২ ও ৩৩ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করা হয়েছে।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নে ড. শাহদীন মালিক বলেন, “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে। তাই রিমান্ডে নিয়ে কোনোভাবেই কাউকে নির্যাতন করতে পারে না।”

শহিদুলের স্ত্রীর দায়ের করা এই রিটে স্বারাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, ডিবির ডিআইজি এবং রমনা থানার ওসিকে বিবাদী করা হয়েছে।

নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে সাত দিন পুলিশ রিমান্ডের আদেশ পাওয়ার আগে শহিদুল আলমকে নির্যাতন  কেন ‘বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত’ ঘোষণা করা হবে না- এই মর্মে রুল চাওয়া হয়েছে এই রিটে। 

দৃক গ্যালারি ও পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল অধিকার আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত শনি ও রোববার জিগাতলা এলাকায় সংঘর্ষের বিষয়ে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফেইসবুক লাইভে আসেন তিনি। ওই আন্দোলনের বিষয়ে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরকারের সমালোচনাও করেন।

এরপর রোববার রাতে শহিদুলকে তার ধানমণ্ডির বাসা থেকে আটক করে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। সোমবার রমনা থানায় তার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করে হাজির করা হয় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে।

ওই মামলায় ‘কল্পনাপ্রসূত তথ্যের’ মাধ্যমে জনসাধারণের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ‘মিথ্যা প্রচার’ চালানো, উসকানিমূলক তথ্য উপস্থাপন, সরকারকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও অকার্যকর’ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘অবনতি ঘটিয়ে’ জনমনে ‘ভীতি ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে’ দেওয়ার ষড়যন্ত্র এবং তা বাস্তবায়নে ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ‘অপপ্রচারের’ অভিযোগ আনা হয় আলোকচিত্রী শহিদুলের বিরুদ্ধে।

গোয়েন্দা পুলিশ শহিদুলকে দশ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাইলে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আসাদুজ্জামান নূর সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আদালতে তোলার আগে গাড়ি থেকে নামার সময় শহিদুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমাকে আঘাত করা হয়েছে। আমার রক্ত মাখা পাঞ্জাবি ‍ধুয়ে আবার পরানো হয়েছে।”

আর হাকিম আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শহিদুল বলেন, গ্রেপ্তারের সময় তার চোখ-মুখ বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হয়েছিল।

“তারা আমাকে মোসাদ, আইএসআইর এজেন্ট বলে গালি দেয়, দেশদ্রোহীও বলে তারা। তারা আমাকে মারধরও করে।”

পুলিশ শহিদুলকে আদালতে হাজির করার আগে তার স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে রোববার রাতে বাসা থেকে ‘তুলে নেওয়ার পর’ সোমবার দুপুর পর্যন্ত পরিবার ও আইনজীবীকে কিছু জানানো হয়নি।

“শহিদুলকে ৩০-৩৫ জনের একটি দল অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ সময় বাড়ির সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে তারা হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়। সিসি ক্যামেরায় টেপ মেরে দেয়। নিরাপত্তারক্ষীকে আটকে রাখা হয়। তিনটি গাড়িতে করে তারা এসেছিল এবং কাউকে কথা বলতে না দিয়ে দ্রুত চলে যায়।”