সড়ক পরিবহনের প্রস্তাবিত আইনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

দুই কলেজ শিক্ষার্থীর প্রাণহানির পর আন্দোলনের মুখে সড়ক পরিবহনের যে নতুন আইনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে, তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2018, 05:56 PM
Updated : 6 August 2018, 06:10 PM

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নতুন আইনের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকের শাস্তির মাত্রা ‘কম’ দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতাও বলছেন, প্রস্তাবিত আইনে জনপ্রত্যাশার ‘প্রতিফলন ঘটেনি’। পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবার বলছেন, কিছু ক্ষেত্রে শাস্তির মাত্রা ‘বেশি’ হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর সড়ক অচল থাকার পর গত বৃহস্পতিবার তাদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার।

তার ধারাবাহিতায় সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক পরিবহন আইনের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রস্তাবিত আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় শাস্তি দুই বছর বাড়িয়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ থেকে যে নয় দফা উঠেছিল, তার প্রথমটিই ছিল দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে দায়ী চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের বিধান করতে হবে।

নতুন আইনের খসড়া অনুমোদনের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, যদি কোনো চালক হত্যাকাণ্ড ঘটান, তবে দণ্ডবিধির ৩০২ কিংবা ৩০৪ ধারা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

৩০২ ধারায় খুনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

তবে তাতে সন্তুষ্ট নন শিক্ষার্থীরা।

দুই ছাত্র-ছাত্রীর সড়কে মৃত্যুকে হত্যা দাবি করে তার বিচার দাবিতে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা

ঢাকার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চালকদের দোষে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর শাস্তি আরও বেশি হওয়া উচিৎ ছিল।

“খুনের শাস্তি কখনও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে না।”

চলমান ছাত্র আন্দোলন দমাতে তাড়াহুড়ো করে এই আইন করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে একটা স্ট্রিক্ট আইন করে তা কিছুদিনের কার্যকর রাখলে চালকদের একটু টনক নড়ত। পাঁচ বছরের কারাদণ্ড তাদের কাছে কিছুই না।

“আর আমাদের পুরো সিস্টেম যে পরিমাণ দুর্নীতিগ্রস্ত, যে মন্ত্রীর আওতায় তারা আছে, তাতে পাঁচ দিনও যাবে না। বের হয়ে আসবে।”

উত্তরার একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী আবার বলেন, আইন কঠোর হলেও তা কার্যকর হত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তার।  

“আইনে শাস্তির মেয়াদ আরও বেশি হলেও চালক-মালিকদের কিছুই হবে না। যারা রাজনীতি করে তারাই বাসের মালিক। তাদের অধীনেই পুরো পরিবহন খাত। কাজেই যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটালেও জনগণ কিছু করতে পারে না। রাজনীতিবিদদের বড় হাত আছে, তাতে সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যায়।”

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরকার আইনটি দ্রুত করতে চাইলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে তা নমনীয় হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মোজাম্মেল হক চৌধুরী।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ খসড়ায় মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি।

“আমাদের সবারই প্রত্যাশা ছিল, একটা ভালো আইন হবে। আশা করেছিলাম, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড রাখা হবে। মন্ত্রিসভায় যেটা অনুমোদন হয়েছে, তাতে সরকারের আগের অবস্থানের প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে হয় না।”

মোজাম্মেল বলেন, “গত কয়েকদিনের যে আন্দোলন, এই আন্দোলনের পাল্টায় মালিকরা যানবাহন চালানো বন্ধ রেখেছে। সারাদেশে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘটের মাধ্যমে তারা সরকারকে চাপ দিয়েছে। এই চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আইনকে দুর্বল করা হয়েছে বলে আমি মনে করি।”

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাল্টায় বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা

সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে চান না পরিবহন শ্রমিক নেতারা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুর রহিম বক্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “এই মুহুর্তে আমরা কিছু বলতে চাচ্ছি না। শান্তিপূর্ণভাবে পরিবহনটা সারাদেশে চালু হোক। পরে সরকারের সঙ্গে বসব বিষয়টি নিয়ে।”

আইনটি যুগোপযোগী বলে মনে করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মনে করি আইনটা যুগোপযোগী করা দরকার ছিল, এবার সেটা হয়েছে। যদিও আইনে জরিমানার অঙ্ক ও সাজা তিন বছর থেকে বাড়িয়ে পাঁচ বছর হয়েছে।

“কিছু জায়গায় শাস্তির পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।

এনায়েত উল্লাহর মতে, শুধু আইন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়।

“এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যে বিষয়গুলো আছে, সেসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।”

প্রস্তাবিত আইনটি দুর্ঘটনা কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ।

তবে প্রস্তাবিত আইনটির তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণে সর্বনিম্ন শাস্তির মাত্রাও সুনির্দিষ্ট করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি।

শিক্ষার্থীরা নয় দফা দাবি তুলেছিল, যা মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার

নেওয়াজ বলেন, “এখানে একটা কথা আছে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর। তবে আমার মনে হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাজার একটা মিনিমাম লিমিট রাখতে হবে।

“সর্বোচ্চ সাজার কথা বললে একটা ফাঁক থেকে যায়। যদি বলা হয়, সর্বনিম্ন তিন বছর বা দুই বছর, তাহলে কিন্তু এর কম শাস্তি আর দেওয়া যাবে না। এই বিষয়গুলো মনে হয় একটু আপডেট করা যেতে পারে।”

সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যে আশ্বাস দিয়েছেন, আইনটি পাস হওয়ার আগে সংসদীয় কমিটি সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেবে।

তিনি সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আইনটি সংসদীয় কমিটিতে উত্থাপিত হবে, সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবে। সকল স্টেকহোল্ডার ও সকলের সঙ্গে আলোচনা করে আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করা হবে।”