নির্ভুল থাকা কঠিন, বিভ্রান্তি তৈরি সহজ: তৌফিক খালিদী

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা ট্রাজেডির মতো ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকা পর্যালোচনা করা উচিৎ ছিল বলে মনে করেন সাংবাদিক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2018, 03:27 PM
Updated : 7 August 2018, 02:39 PM

ভূমিকম্প পরবর্তী সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে সেনাবাহিনীর আয়োজনে এক প্রশিক্ষণে আলোচক হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা ট্রাজেডির মতো ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকা কখনোই পর্যালোচনা করে দেখা হয়নি।

“সব ধরনের তদন্ত হয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমকে এই প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে যেতে হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, এটা হওয়া উচিৎ ছিল।”

তৌফিক খালিদী বলেন, যখন দায়বদ্ধতার আলোচনা আসে, গণমাধ্যম এখানে ছাড় পেতে পারে না। কারোরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এড়ানো উচিত নয়। যাচাই-বাছাইয়ের নিজস্ব ব্যবস্থা এবং দর্শকদের বিচার ছাড়াও যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাঝ দিয়ে যাওয়া উচিৎ।

দ্রুত সঠিক তথ্য দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অনেকে সহজ ভাবলেও তা যে কত কঠিন, তা তুলে ধরেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক খালিদী।

“নির্ভুল থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কখনও কখনও সেটা খুব কঠিন হয়ে যায়। স্পর্শকাতর তথ্য, বিশাল সংখ্যার পাঠক নিয়ে কাজ করার সময় বিভ্র্রান্তি তৈরি করা সহজ। দুর্যোগ আসার উপক্রম হলে বা দুর্যোগ আঘাত হানলে ভুল তথ্য ভয়ঙ্কর ফল ডেকে আনতে পারে।”

ভুল তথ্য এড়াতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিভাগের, এমনকি সেনাবাহিনীকেও ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসার আহ্বান জানান তিনি।

মিশরে সেনাবাহিনী এবং যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে কার্যকরভাবে সোশাল মিডিয়া ব্যবহারের দৃষ্টান্তও দেন তৌফিক খালিদী।

আলোচনায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তার মন্ত্রিসভার রদবদলের খবরও দিতেন টুইটারে, তা থেকেই অন্যরা খবর সংগ্রহ করেছে।

ভূমিকম্প পরবর্তী সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতার ওপর অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণে রোববার শুরু হয় ৫ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।

সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড ও আর্মি ওয়ার গেম সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে এই বিশেষ প্রশিক্ষণ হচ্ছে। বাংলাদেশে এটিই প্রথম ভূমিকম্পের ওপর কম্পিউটারভিত্তিক প্রশিক্ষণ।

এই আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে ‘গণমাধ্যম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্ত সরকারি নীতি : ধারণা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

আলোচনায় আরও অংশ নেন ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের উপাচার্য  মেজর জেনারেল মো. ইমদাদ-উল-বারী, বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির, সাবেক সচিব মিকাইল শিপার প্রমুখ।

প্যানেল আলোচনায় প্রথমে অংশ নেন মেজর জেনারেল ইমদাদ-উল-বারী। তার আলোচনার বিষয় ছিল ‘গণমাধ্যম এবং সশস্ত্র বাহিনী: বাংলাদেশের ধারণা ও বাস্তবতা’।

‘ডিজাস্টার রেসপন্স এন্ড মিডিয়া এজ এ ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ বিষয়ে আলোচনা করেন তৌফিক ইমরোজ খালিদী।

‘ডিজাস্টার রেসপন্স (ভূমিকম্প/ভবন ধস) এবং গার্মেন্টস খাতে এর প্রভাব’ শীর্ষক বিষয়ে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির আলোচনা করেন। সাবেক সচিব মিকাইল শিপার ‘ভূমিকম্প: শিল্প অবকাঠামো এবং কর্মী বাহিনীর উপর এর প্রভাব’ শীর্ষক বিষয়ে আলোচনা করেন।

ঢাকা সেনানিবাসে সোমবার ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার উপর প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় দিনে ‘গণমাধ্যম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্ত সরকারি নীতি: ধারণা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনায় অতিথিরা।

অনুষ্ঠানে সঙ্কটকালে বা দুর্যোগকালে সাংবাদিকতা, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা, সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে গণমাধ্যমের যোগাযোগ বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা সাংবাদিকতার মতো বিষয়ে কথা বলেন বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্রের সম্পাদক। সেনা কর্মকর্তাসহ প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দেন তিনি।

একটি দায়িত্বশীল বার্তাকক্ষে ঘটনাস্থল থেকে পাঠানো একটি খবর কীভাবে কোন প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে যেতে হয়, তার বিষদ বর্ণনা দেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত তৌফিক খালিদী।

তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে খবর দিতে গণমাধ্যম নির্ভর করে ঘটনাস্থলে থাকা তাদের প্রতিবেদকদের উপর। তবে প্রতিবেদকের পাঠানো খবর তখনই প্রকাশ হয়, যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক বা বার্তা সম্পাদক তাতে সন্তুষ্ট হন।

তিনি বলেন, বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রাসঙ্গিকতা, স্পর্শকাতরতা বা এই খবর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ফলকে উস্কে দেবে কি-না ইত্যাদিও বিবেচনা করতে হয়। এ রকম বিষয় উঠলে সেটা আরও উচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। এই প্রক্রিয়া অতিক্রম করতে পারলেই সংবাদ আলোর মুখ দেখে।

“এই সম্পাদকীয় প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়া যথাযথভাবে না মানার দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। এমনও দেখা গেছে, সম্প্রচারকারী বা সংবাদ প্রকাশকারী ন্যূনতম ক্ষমা না চেয়েই একটি খবর প্রত্যাহার করে ফেলছে।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, ইন্টারনেটে সংবাদ প্রকাশকদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হয়

ইন্টারনেটে সংবাদ প্রকাশকদের আরও বেশি সতর্ক থাকার গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি।

“এখন রয়েছে আরএসএস ফিড, খুবই কার্যকরি সার্চ ইঞ্জিন, বিভিন্ন ধরনের অ্যালার্ট। তাই বিশেষ করে যদি কোনো খারাপ খবর হয়, তাহলে সেটা আরও দ্রুততর ছড়ায়। এমনকি ভুল বুঝতে পারার পর কেউ সাইট থেকে খবর নামিয়ে নিলেও সেটা এরই মধ্যে অন্য কেউ সেটা নিয়ে ছড়িয়ে দেয়।”

সম্পাদকীয় প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব দিয়ে তৌফিক খালিদী বলেন, দুর্যোগে অনেক সময় এমন মানবিক আবেদনধর্মী এমন ভিডিও বা ছবি পাওয়া যায়, যেটা কাউকে বীর বা খলনায়ক বানিয়ে দিতে পারে। কোনো এলাকার একটা বিশেষ ছবি এই ধারণা দিতে পারে যে, ওই এলাকাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বাস্তবে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্নও হতে পারে।

ঢাকা সেনানিবাসে সোমবার ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার উপর প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় দিনে ‘গণমাধ্যম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সশস্ত্র বাহিনী সংক্রান্ত সরকারি নীতি: ধারণা ও বাস্তবতা’ শীর্ষক আলোচনায় অতিথিরা।

তাৎক্ষণিক সংবাদ প্রকাশে ঘটনাস্থলে থাকা প্রতিবেদক ভুল খবর দিলে কী হবে- এক সেনা কর্মকর্তার এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই প্রতিবেদকদের অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর নিয়োগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা শব্দ হচ্ছে ‘বিশ্বাস’, এটা থাকতে হয়।

“তবে যে কোনো ঘটনায়ই প্রতিবেদককে অনেক প্রশ্নের মাঝে দিয়ে যেতে হয়। তাতে উত্তীর্ণ হলেই কেবল সেটা প্রকাশ করা হয়। যত বড় ঘটনা, তত সিনিয়র সম্পাদকরা এই যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করেন।”

গণমাধ্যমের দুটি মৌল ভূমিকা পাঠককে তথ্য দেওয়া এবং সেই সঙ্গে পাঠককে শিক্ষিত করার বিষয়টিতেও আলোকপাত করেন তৌফিক খালিদী।

তিনি বলেন, পেশাদার গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিকরা কখনও কখনও বা প্রয়োজনে ঘটনা-দুর্ঘটনা বা সংবাদের বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যাও দিয়ে থাকেন। প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়। ‘সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য’ এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসে অনুমাননির্ভর খবরের প্রসঙ্গ।

এ বিষয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, বার্তা কক্ষে অনুমানের কোনো জায়গা থাকতে পারে না।

তিনি বলেন, “প্রায় এক যুগ আগে আমরা ‘টু-সোর্স’ থিউরি চালু করেছিলাম। তখন অনেকে বলেছে, এটা বাংলাদেশে সম্ভব না। ‘টু-সোর্স’ থিউরি কী? এটা হচ্ছে, একটি সংবাদে দুটি সোর্স ব্যবহার করা। এই সোর্স নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলে হবে না। সাংবাদিকতার একজন অধ্যাপক বলেছিলেন, এই ‘টু-সোর্স’ থিউরির মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে বদলে দিয়েছি।”

আলোচনার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদকের হাতে তুলে দেওয়া হয় স্যুভেনির

মঞ্চে থাকা দীর্ঘদিন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে কাজ করা আসা সাবেক সচিব মিকাইল শিপারের দিকে ইঙ্গিত করে তৌফিক খালিদী বলেন, “তিনি হয়ত জেনে থাকবেন, আমাদের রিপোর্টররা ‘কোটে’র জন্য ইনসিস্ট করতে থাকে।

“তবে আমরা যদি ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ সোর্সকে পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারি, তাহলে কখনও কখনও তার নাম ছাড়াও সংবাদ যেতে পারে। তবে এর জন্য খুবই উচ্চ পর্যায়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়।

“আপনারা ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ সোর্স দিয়ে রাজনৈতিক খবর দেখেন। এটা অনুমাননির্ভর খবরের উৎস। অনেক সংবাদ ব্যবস্থাপকরা এটা চলতে দিয়েছেন।”

বাংলাদেশে এখন প্রচুর সংবাদ প্রকাশক থাকলেও সম্পাদকীয় নেতৃত্বের সঙ্কটের দিকটি তুলে ধরেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক।

তিনি বলেন, “সংখ্যায় বেশি হলে অনেক সময় মানও কমে যায়। আপনার ২০০ টিভি থাকতে পারে, কিন্তু ৩০-৪০টা জাতীয় পর্যায়ের নিউজ চ্যানেল থাকতে পারে না।

“আমি আপনার সাথে একমত যে, যেভাবে পিলখানা ট্রাজেডি কাভার করা হয়েছে, সেটা সঠিক ছিল না। যাচাই বাছাই ছাড়াই আমরা ভিক্টিমদের নাম বলে দিয়েছি।”

বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তৌফিক খালিদী বলেন, “দেখা গেছে, আমরা ভিক্টিমের নাম জানতাম, কিন্তু তারপরও প্রকাশ করতাম না। এটার একটা পদ্ধতি আছে। প্রথমে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওই পরিবারের কাছে যেত, তাদেরকে জানাত, তাদেরকে সাইকোলোজিস্ট বা অন্যান্য সাপোর্ট দেয়া হত।

“কিন্তু আমরা এখানে এমনও দেখি, একজন মারা গেল, হয়ত মরদেহও উদ্ধার হয়নি। কিন্তু রিপোর্টার প্রশ্ন করছে, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?”

আলোচনার পর চার অতিথির হাতে স্যুভেনির তুলে দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইবনে ফজল শায়খুজ্জামান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তোফায়েল আহমেদ।