তৃতীয় পক্ষ নেমেছে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফের: প্রধানমন্ত্রী

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সুযোগ নিতে ‘তৃতীয় পক্ষ’ নেমেছে জানিয়ে আন্দোলনরতদের এখন ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2018, 05:29 AM
Updated : 5 August 2018, 09:26 AM

রোববার ঢাকায় গণভবনে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে এই আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু আমরা এখন যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা আরও ভয়ানক। এর ভেতরে তৃতীয় পক্ষ চলে এসেছে। স্কুল পোশাক ও আইডি কার্ড বিক্রি বেড়ে গেছে হঠাৎ করে।

“কাজেই এইগুলি কারা করছে? এরা কি আদৌ ছাত্র। কখনও মুখে কাপড় বেধে এদের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ঢাকার বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসছে এখানে। তাদের কাজটা কী হবে? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করা। যখনই আমি এটা দেখলাম তখনই আমি আতঙ্কিত এই শিশুদের নিয়ে।

“যারা আগুন দিয়ে মানুষ মারতে পারে। যারা অনিক, হৃদয়, এদের মত মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে পারে, তারা কি না পারে এদেশে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “সে কারণেই অনুরোধ শিক্ষক, অভিভাবক, পিতামাতা; আপনাদের সন্তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনাদের। কাজেই তাদেরকে রাস্তা থেকে তুলে স্কুলে পাঠান। কলেজে পাঠান। তারা পড়াশোনা করুক।

“তৃতীয় শক্তি এরা মানুষ না। এরা পারে না এমন কোনো কাজ নেই। অগ্নি-সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীরা যে কোনো অঘটন ঘটাতে পার।”

গত ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা; সড়কে চালকের ও গাড়ির ‘লাইসেন্স পরীক্ষায়’ পুলিশের কাজে নেমে যায় তারা। তাদের ‘পরীক্ষায়’ অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও মন্ত্রী-এমপিরাও আটকা পড়েন।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা স্বীকার করে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নয়টি দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও তারা রাজপথ ছাড়েনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “আমি এখন শঙ্কিত এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে। কারণ যারা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শিক্ষার্থীদের হত্যা করতে পারে, পুড়িয়ে মানুষ মারতে পারে। যারা পেট্রোল বোমা মেরে মেরে চলন্ত বাস, ট্রেন, গাড়ি, সিএনজি পুড়িয়ে মানুষ মারা-এই ধরনের ভয়ংকর কাজ যারা করতে পারে, তারা যদি এসবে নেমে আসে তাহলে তারা কি না করতে পারে।”

রোববার থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে আমরা ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করেছি। তার আগে ছোট বাচ্চারা করেছে। খুব ভাল কথা। এখন আর তাদের ট্রাফিক দেখার দরকার নেই। তারা যদি কেউ স্বেচ্ছা সার্ভিস দিতে পারে, তাদেরকে আমরা কাজে লাগাতে পারি।

“গাড়ির কাগজপত্র দেখা, ফিটনেস দেখা, এটা পুলিশের দায়িত্ব। তারা দেখবে।”

শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দুর্ঘটনার পর থেকে তারা রাস্তায় নেমে এসেছে। গত কয়েকদিন পর থেকে তারা যা যা করার করেছে। গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করা, আমি জানি না, তারা কতটুকু এটা বোঝে।

“পুলিশ, র‌্যাব সকলেই কিন্তু ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে এতে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এমনকি তারা যা বলছে, এমনকি মন্ত্রী, এমপির গাড়িতে তারা যা যা করছে, তারা কিন্তু তা মেনে নিচ্ছে। তারা বাধা দেয়নি। কারণ তাদের অনুভূতি, তাদের সেন্টিমেন্ট আমরা বুঝতে পারি।

“এরকম একজন সহপাঠি মারা গেলে কি অনভূতি হয় তা আর কেউ না বুঝুক আমার চেয়ে বেশি কেউ বোঝে না। কারণ আমি আমার পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছি।”

২০১৪-২০১৫ সালে সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধের সময় নাশকতায় অনিক, হৃদয়ের মতো স্কুলছাত্রদের চোখ নষ্ট ও  আহত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “এরকম বহু শিশু অগ্নিসন্ত্রাসে আহত-নিহত হয়েছে।

“আমাদের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় নেমেছে আমরা তাদের কোনো রকম বাধা দিইনি, বরং সহযোগিতা করেছি।  পুলিশের হোন্ডা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বাস জ্বালিয়েছে। অনেক কিছু, কিন্তু সবাই ধৈর্য ধরেছে।”

তবে একটা পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।

“একটা পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে। সেটা কিন্তু তারা করে যাচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে তারা কোনোমতে একটা অবস্থান তৈরি করতে পারে কি না।

“ফেইসবুকে তারা গুজব ছড়ালো যে, আওয়ামী লীগ অফিসে নাকি চারজনকে মেরে লাশ রেখে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ অফিসে যে আক্রমণ, এই আক্রমণটা কারা করল? আমাদের ১৭/১৮ জন কর্মী সেখানে আহত, তারা হাসপাতালে ।

“তাদের (হামলাকারী) ব্যাগের ভেতরে পাথর। তারা ছাত্র যদি হয়, তাহলে তাদের ব্যাগে বই থাকবে। পাথর থাকবে কেন? আর সেই পাথর আওয়ামী লীগ অফিসে তারা ছুড়ে মেরেছে।

শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, “বিডিআর গেইটে হামলা। সেখানে ফাঁকা গুলি হচ্ছে। এই অস্ত্রটা কোত্থেকে আসল? কারা দিল?

“অপপ্রচার চালিয়ে দেশের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করা এবং এটা যারা করতে পারে তারা যে কোমলমতি শিশুদের ওপর আঘাত করবে না, ক্ষতি করবে না?

নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানী রামপুরা সেতুর উপর শিক্ষার্থীদের অবস্থান। শনিবারের ছবি

“যারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারতে পারে তারা তাদের স্বার্থে যেকোন কিছু করতে পারে। ছোট শিশুকেও তো তারা আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেজন্য আমি সমস্ত অভিভাবক, পিতামাতা তাদেরকে আমি অনুরোধ করবো যে তারা যেন শিশুদেরকে ঘরে রাখে। তারা যেটুকু করেছে যথেষ্ট। আমরা তাদের বাধা দিইনি। কিন্তু এখন এই তৃতীয় পক্ষ যে কোনো অঘটন যদি ঘটায়, তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে?

“সেজন্য আমি আপনাদের সতর্ক করতে চাই যে, দয়া করে আপনারা আপনাদের ছেলেমেয়েদেরকে এবং প্রত্যেকটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকলকে আমি অনুরোধ করব, আপনারা আপনাদের ছাত্রদের ক্লাসে ফিরিয়ে নেন।”

ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীও ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।

এসময় দেশের কিছু গণমাধ্যমের ভূমিকারও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের দেশে কিছু কিছু পত্র-পত্রিকা আছে। আমাদের দেশের সুস্থ ধারা রাজনীতি থাকলে তাদের পছন্দ হয় না। তারা সবসময় চায় একটা অন্যকিছু ঘটুক। ‍তারা মন্ত্রী হতে পারে, পতাকা পায়, এজন্য আকাঙ্ক্ষা অনেকেরই আছে।

“তারা নির্বাচিত হয়ে সরকারে আসতে পারে । আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করা বা এই ধরনের মিথ্যাচার করে করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার কি অধিকার তাদের আছে?”

প্রধানমন্ত্রী গুজবে কান দিয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ারও আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “আজকের ডিজিটাল প্রযুক্তি মানুষের সেবাও যেমন বাড়ছে, আবার কিছু কিছু ঝামেলাও পোহাতে হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে দেশের ভেতর একটা অশান্তি পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

“সেখানে আমরা বলবো, কেউ গুজবে কান দেবেন না বা এই মিথ্যা অপপ্রচারে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। যা কিছু শোনেন আগে যাচাই করে নেবেন। বিশেষ করে আমাদের স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী, যুব সমাজ তাদের প্রতি আমাদের এই আহ্বান থাকবে।”

দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন,  “সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। যারা গাড়ি চালক তাদেরকেও যেমন বলেছি, তারা যেন ট্রাফিক রুল মেনে গাড়ি চালায়। আবার যারা পথচারী, যাতায়াত করে তাদেরকেও ট্রাফিক রুল সম্পর্কে জানতে হবে।

“ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা শিখিয়েছি স্কুল থেকেই যেন ট্রাফিক রুল শেখানো হয়।”

দুর্ঘটনা কমাতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, আন্ডার-পাস, ওভার পাস করে দিচ্ছি।

এছাড়া সড়ক প্রশস্তকরণ, মূল হাইওয়ের পাশে আলাদা সড়ক করা, চারপাঁচ ঘন্টা পরপর ড্রাইভারদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি। 

শেখ হাসিনা বলেন, “এদের (আন্দোলনকারীদের) দাবি দাওয়া যা যা ছিল সবই একে একে বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। প্রত্যেকটা জায়গায় যেখানেই স্কুল সেখানেই ট্রাফিক পুলিশ থাকবে এবং রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা করে দেবে।

তবে সবাইকে ওভার ব্রিজ ব্যবহার করার আহ্বান।

অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন (ইনফো-সরকার ৩য় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১০টি জেলার ৩০০ ইউনিয়নের অপটিক্যাল ফাইবার কানেক্টিভিটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সঞ্চালনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এবং তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বক্তব্য দেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার সুবিধাভোগী, কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন।