পুলিশের ভূমিকায় ‘কোমলমতি’, আইনের লোক বিপাকে

সড়কে নিয়ম ফেরানোর দাবি নিয়ে রাজপথে নেমে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পর আইনের প্রতি খোদ আইনের লোকের অবহেলার অজস্র নমুনা বেরিয়ে এসেছে। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 August 2018, 04:13 PM
Updated : 2 August 2018, 06:48 PM

বুধবারের মত বৃহস্পতিবারও স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীরা রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যানবাহন ও চালকের লাইসেন্স দেখতে চেয়েছেন। পুলিশ, বিজিবি, আইনপ্রণেতা, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ অনেকেই ফেল করেছেন সেই পরীক্ষায়।

শিক্ষার্থীরা এসব চালককে পুলিশে সোপর্দ করার পর লাইসেন্স না থাকার মামলা দেওয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি এক পুলিশকে আরেক পুলিশের মাধ্যমে মামলা দেওয়ার ঘটনাও রাজধানীতে ঘটেছে।

এই পরিস্থিতিতে সরকারি গাড়ি চালকদের যাবতীয় মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। অথচ বিআরটিএ এর নিয়ম অনুযায়ীই গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভিং লাইসেন্স, বীমার কাগজ ও ব্লুবুক সঙ্গে রাখার কথা চালকদের।

কাফরুল থানার কনস্টেবল শিহাব কাগজ ছাড়াই রাস্তায় বেরিয়ে সকালে মিরপুর-১০ এলাকায় আন্দোলকারী শিক্ষার্থীদের সামনে পড়েন। লাইসেন্স দেখাতে না পেরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন তিনি।

কনস্টেবল শিহাব সাংবাদিকদের বলেন, “আমার কাগজতো আসলে বাসায় ট্রাঙ্কের ভেতরে। ওরাতো আজকে ধরছে, ধরুক, ওদেরকে সাপোর্ট করছি।’

কয়েকজন ছাত্রকে এ সময় বলতে শোনায় যায়, “আঙ্কেল আমার ইচ্ছা ছিল পুলিশ হওয়ার। আপনাদের দেখে ইচ্ছা চলে যাচ্ছে।”

আরেকজন বলে, “আপনারা নিজেরাই আইন মানেন না, তাহলে আইন মানাবেন কীভাবে?’

মগবাজার মোড়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে অবরুদ্ধ করা হলে তিনি গাড়ি থেকে নেমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন

সাত রাস্তার দিক থেকে সচিবালয়ে যাওয়ার সময় মগবাজারে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের গাড়ি। পরে তিনি বেরিয়ে এসে বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়গুলো তিনি মন্ত্রিসভায় তুলবেন। পরে তাকে যেতে দেয় শিক্ষার্থীরা।

তবে সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথের ভাগ্য অতটা ভালো ছিল না। শনির আখড়ায় তার গাড়ির চালক লাইসেন্স দেখাতে না পারায় দুই ঘণ্টা আটকে রেখে পুলিশকে মামলা নিতে ‘বাধ্য করে’ শিক্ষার্থীরা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পংকজ বলেন, ৪ জুলাই তার চালকের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা এজন্য গাড়ি আটকে রেখেছিল। পরে পুলিশ এসে মামলা দিয়েছে।

মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় কাগজবিহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন কয়েক ডজন গাড়ি আটকে পুলিশে দেয় শিক্ষার্থীরা। দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা গাড়ি ধরে নিয়ে আসছে, আর পুলিশ মামলা নিচ্ছে।

ট্রাফিক কনস্টেবল জাহাঙ্গীরের মোটরসাইকেলও সেখানে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়ে। আন্দোলনকারীরা জাহাঙ্গীরের গাড়ি সেখানে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট দেলোয়ারের কাছে নিয়ে যায় মামলা দেওয়ার জন্য।

কিন্তু দেলোয়ার তাৎক্ষণিকভাবে মামলা না দিয়ে জাহাঙ্গীরের আইডি কার্ড ও চাবি রেখে দিয়ে শিক্ষার্থীদের শান্ত করেন।

চালকের লাইসেন্স না থাকায় কাঁটাবন মোড় এলাকায় পুলিশের একটি বাস আটকে দেয় শিক্ষার্থীরা। ওই বাসের চালক পুলিশ কনস্টেবল জাহাঙ্গীর বলেন, “লাইসেন্স চেকিং হইতেছে এই বিষয়টা আমি জানতাম না।”

আন্দোলনকারীরা গাড়িটি আটকে চাবি নিয়ে যায়। কাগজপত্র দেখালে চাবি ফেরত দেবে বলে জানায়। একজন শিক্ষার্থী দাবি তোলে, লাইসেন্স দেখাতে না পারলে গাড়িটি ডাম্পিংয়ে পাঠাতে হবে।

দুপুরে ধানমণ্ডির সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে পুলিশের ডিআইজি রত্না খন্দকারের গাড়ি আটকে দেয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। চালকের কাছে লাইসেন্স দেখতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা দুর্ব্যবহার করেন বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। পরে তারা গাড়িটি দীর্ঘসময় আটকে রেখে দেয়।

আন্দোলকারীরা লাইসেন্স দেখতে চাওয়ার পর ‘দিচ্ছি’ বলে নেমে কাগজ না দেখিয়েই সটকে পড়েন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) একটি পিক-আপের চালক।

শান্তিনগরের রাস্তায় পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে রামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবুল খায়ের পাটোয়ারীর গাড়ি দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয় চালক লাইসেন্স দেখাতে না পারায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে আবুল খায়ের বলেন, “লাইসেন্সটা আমার এখনো রিনিউ হয়নি। রামগঞ্জ থেকে ঢাকার ডিসি অফিসে কাজে আসছিলাম। আমার মূল ড্রাইভার অসুস্থ, এর লাইসেন্স নাই। না এসে উপায় ছিল না। ইয়ের এগেইন্সটে একটা মামলা দিয়ে দিলেও তো হইত, এখন তো সেটার স্কোপও দেখতেসি না।"

গাড়ি আটকে রাখা শিক্ষার্থীদের একজন এ সময় বলতে থাকে- “কোনো মামলা হবে না, লাইসেন্স নিয়ে আসেন। এত কাজ পারেন, লাইসেন্সও আনতে পারবেন।”

আন্দোলনকারীদের আরেকজন বলে, “তার লাইসেন্সওয়ালা ড্রাইভার আসবে, তারপর ছাড়ব। এই গাড়ি হাইওয়েতে চলে কি করে।"

খামারবাড়ির দিক থেকে আসা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় লেখা একটি গাড়ি আসাদগেট এলাকায় আটকে দেয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় শত শত শিক্ষার্থী গাড়িটি ঘেরাও করে চাবি কেড়ে নেয়।

তারা স্লোগান দিতে থাকে - কোনো কার্যালয় বলা চলবে না। কাগজপত্র না থাকলে পুলিশের হাতে যাবে।

দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার পর এক পর্যায়ে গাড়িটি ছেড়ে দেয় ছাত্ররা। তবে তার আগে গাড়ির উইন্ড শিল্ডে লিখে দেওয়া হয়- ‘প্রধানমন্ত্রী, লাইসেন্স কোথায়?’

একইভাবে আরেকটি গাড়ির কাচে লিখে দেওয়া হয়- ‘বিচারপতি, লাইসেন্স কোথায়?’

ওই এলাকায় পুলিশ বহনকারী বেশ কিছু গাড়িও এই কিশোর তরুণদের হাতে আটকা পড়ে। সেখানেও একটি পুলিশ বক্সে শিক্ষার্থীদের ধরে আনা লাইসেন্স ও কাগজপত্রবিহীন গাড়ির চালকদের মামলা দিতে দেখা যায়।

উত্তরার জসিমউদ্দিন মোড়ে পুলিশের ভূমিকায় থানা শিক্ষার্থীদের সামনে পড়েন মোটরসাইকেলআরোহী এক র‌্যাব সদস্য। লাইসেন্স না দেখাতে পেরে তাকেও আটকে থাকতে হয়।

বিজিবির একটি গাড়ি একই কারণে শাহবাগে বিক্ষোভের মধ্যে আটকে যায়। পরে পিলখানা থেকে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গিয়ে ওই গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে হয়।

বিকাল সোয়া ৩টার দিকে মিরপুর দশ নম্বর মোড়ে হাজির হয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক প্রকৌশলী মাসুদুল আলম। তিনি কাগজে লিখে তাতে সইও দেন। 

তিনি জানান,  ফিটনেস ও লাইসেন্সের কাগজ না থাকায় সকালে ৩০টি মোটর সাইকেল, সাতটি গাড়িসহ বেশকটি লেগুনাকে আটকে রেখেছিল শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে পুলিশের পাঁচটি মোটরবাইকও ছিল। লাইসেন্স না থাকায় বিআরটিএ এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে।

সড়কে যানবাহনের ফিটনেস ও লাইসেন্স নিরীক্ষা করতে বিআরটিএ’র  নিজস্ব কার্যক্রম ‘অব্যাহত রয়েছে’ দাবি করে এই কর্মকর্তা বলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে আমরা একমত। তাদের দাবি অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মূল কাগজপত্র ‘একটু সেনসেটিভ’ হওয়ায় অনেক সময় সরকারি গাড়ির কাগজ অফিসে সংরক্ষণ করা হয়। তবে ওইসব কাগজের ফটোকপি চালকরা সঙ্গে রাখেন। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স চালকদের সঙ্গে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয় সব সময়।

“এখন তো পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। ওদেরকে (গাড়ি চালকদের) বলে দিয়েছি এখন থেকে মূল কাগজপত্র সঙ্গে রাখতে, মূল কাগজই তারা সঙ্গে রাখবে।”

সড়কে আইন মানতে সরকারি লোকের এই অনিহার চিত্র স্পষ্ট করে তোলায় অনেকেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ‘কোমলমতি’ শিক্ষার্থী বাহাবা দিচ্ছেন।

অবশ্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলছেন, এটা নতুন কিছু নয়; বাংলাদেশে তিনিই প্রথম এটা শুরু করেছিলেন।

 সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি তো অলওয়েজ রাস্তায় ছিলাম। আমি অলওয়েজ এ কাজগুলো করেছি। এটা তো নতুন তারা দেখাচ্ছে এমন তো না। এটা দেখিয়েছি বাংলাদেশে আমি। আমি রাস্তায় গিয়ে এসব চেকিং গুলো শুরু করেছি।”

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের গাড়ির চালকের লাইসেন্স না পেয়ে ঢাকার সায়েন্সল্যাব মোড়ে গাড়িটিকে অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীরা।

নিরাপদ সড়কের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে শাহবাগ মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

শিক্ষার্থীরা যেসব অনিয়ম ধরছে, তা এতদিন পুলিশের চোখ এড়িয়ে গেল কীভাবে- এই প্রশ্নে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুলিশের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসে তা ঠিক নয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারণে প্রতিদিন আমরা মামলা করছি। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্সের চেয়ে গাড়ির সংখ্যা বেশি, এটা বাস্তবতা। এ নিয়ে আমরা বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে কাজ করছি।”

ট্রাফিক পুলিশ ঘুষ খেয়ে লাইসেন্সের অনিয়ম ছেড়ে দেন- এ রকম ঢালাও অভিযোগও মানতে রাজি নন এই পুলিশ কর্মকর্তা। 

তিনি বলেন, “অভিযোগ সবার বিরুদ্ধেই আছে। কাজ করলে অভিযোগ আসবেই। তবে পুলিশ সার্বিকভাবে চেষ্টা করে তার কাজকে স্বচ্ছ রাখার জন্য।”

পুলিশের দায়িত্ব কেন শিক্ষার্থীদের নিতে হল- এ প্রশ্নে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, “এই ম্যান্ডেট তাদের দেওয়া হয় নাই। এটা একমাত্র পুলিশই করতে পারে। এটা তারা ভাবতে পারে যে পুলিশ ঠিকমত করে না। এই ক্ষোভ থেকে তারা হয়ত করছে, কিন্তু তারা এটা করতে পারে না।”

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন লিটন হায়দার, কামাল তালুকদার, শহীদুল ইসলাম, ওবায়দুর মাসুম, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, তাবারুল হক, জয়ন্ত সাহা, ফয়সাল আতিক,কাজী মোবারক হোসেন, কাজী নাফিয়া রহমান সাজিয়া আফরিন, তারেক হাসান নির্ঝর; সঙ্কলনে সহযোগিতা করেছেন মাসুম বিল্লাহ।]