আন্দোলনকারীদের সব দাবি পূরণে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়ে তাদের এখন ঘরে ফেরার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি; এক্ষেত্রে অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহায়তাও তিনি চেয়েছেন।
ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে গত ২৯ জুলাই বাসচাপায় দুই কলেজছাত্রের মৃত্যুর পর টানা পাঁচ দিন ধরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজধানীর সড়কগুলো দিনভর অচল রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন নির্দেশনা ও কর্তৃপক্ষের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
শিক্ষার্থীরা যে নয়টি দাবি তুলেছে, তার সবগুলো যৌক্তিক বলে স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এর পাশাপাশি তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে রাজনৈতিক ইন্ধন দেখা যাচ্ছে। আমরা দেখেছি, এই আন্দোলনের মধ্যে শিবির ও ছাত্রদল সম্পৃক্ত হয়েছে।
“আমাদের কাছে ছাত্রদল ও শিবিরের কথোপকথনের অডিও রয়েছে। সেখানে ছাত্রদলকে স্কুল ও কলেজের ড্রেস পরে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার নির্দেশ দিতে শোনা গেছে।”
শিক্ষার্থীদের সতর্ক করে তিনি বলেন, “এই আন্দোলন সহিংসতার দিকে টার্ন করতে পারে। কারণ, আমরা দেখিছি কাফরুল থানায় আক্রমণ করা হয়েছে। রাজারবাগ ও মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজম্যান্ট-এ ঢিল ছোড়া হয়েছে।”
মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশনে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের সঙ্গে সরকার সমর্থক যুবকদের হামলার অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সেখানেও ছাত্রদলের কর্মীরা পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছিল, তখন তা প্রতিরোধে স্থানীয়রা এগিয়ে গিয়েছিল বলে তিনি খবর পেয়েছেন।
গত পাঁচ দিনের আন্দোলনে যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “এই কয়দিনে ৩১৭টা গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। আটটি গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। তাই আমরা এই আন্দোলন কনটিনিউ না করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহায়তা চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা মনে করি, তারা যে সাহসিকতা দেখিয়েছে, তা দেশবাসী জেনে গেছে। সুতরাং এই ধরনের পরিস্থিতিতে একটা স্যাবোটাজ ঘটতে পারে।
“তাই অভিভাবক, শিক্ষক ও গভর্নিং বডির সদস্য ও প্রতিবেশীকে অনুরোধ করব, এই কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যাতে মাঠে না নামে, তাদেরকে বোঝাতে।”
এই আন্দোলন ঘিরে নানা ‘অশ্রাব্য উক্তি’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখার কথা জানিয়ে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “এর পেছনে একটি রাজনৈতিক অভিলাষ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য….. ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে আমরা মনে করছি।”
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার গুরুত্ব তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, “এখন যে পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেই যেতে পারে। একটা সাবোটাজ ঘটে যেতে পারে। সেজন্য তাদেরকে আমরা ফিরে যেতে বলব।
“যদি কিছু ঘটে যায়। এর দায়-দায়িত্ব কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী নিতে পারবে না। কারণ নিরাপত্তা বাহিনী কিন্তু চুপচাপ বসে আছে, আপনারা সবাই লক্ষ্য করেছেন। তারাও (নিরাপত্তা বাহিনী) মার খাচ্ছে, কিন্তু তারা কোনো কিছু করছে না। তারা চরম ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিত মোকাবেলা করছে। এই ঘটনা (স্যাবোটাজ) তাদের অ্যাকশনের আগেই ঘটে যেতে পারে।”
তাই শিশু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভেবে তাদের ঘরে ফিরে যেতে প্রধানমন্ত্রী চাইছেন বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি যথেষ্ট হয়েছে। তারা ফিরে যাবে, এটা আমরা আশা করছি।”
আন্দোলন থেমে গেলে এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তারা অনেক ছোট ছোট। এই কারণে তাদেরকে কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।”
শিক্ষার্থীর বিভিন্ন দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, কোনো স্কুল-কলেজের পাশে রাস্তা থাকলে সেখানে ট্রাফিক পুলিশ থাকবে এবং শিক্ষার্থীদের রাস্তা পারাপারে সহযোগিতা করবে।
যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই কলেজছাত্রী নিহত হয়েছেন, সেখানে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “আজ প্রধানমন্ত্রী এই দুই পরিবারের স্বজনদের ডেকে নিয়ে এসেছিলেন এবং সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের কষ্টের কথা শুনেছেন এবং আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থাও করেছেন।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়েছেন, নয় দফা যে দাবি তারা (শিক্ষার্থী) করেছিল, সব দাবিই যৌক্তিক এবং তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, দাবিগুলো যেন আমরা সম্পন্ন করি।”
এর মধ্যে দুই-একটি দাবি পূরণে সময় চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এর মধ্যে দুই-একটি দাবি পূরণে সময় লাগবে যেমন ফুটওভার ব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস।”
সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে নতুন আইন শিগগিরই সংসদে উপস্থাপন করা হবে বলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান।
তিনি বলেন, “যারা অন্যায় করবে কিংবা করেছেন, তারা সর্বোচ্চ শাস্তি যাতে পায়।”
ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, “যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি যাতে রাস্তায় উঠতে না পারে, সেজন্য গাড়ির যাত্রার পয়েন্টে অর্থাৎ টার্মিনালে চেকপোস্ট বসিয়ে দেব। গাড়িটি বের হওয়া সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই যেন ধরা পড়ে যে গাড়ির ফিটনেস আছে কি না, রেজিস্ট্রেশন ও চালকের লাইসেন্স সঠিক আছে কি না। তারপরও চালক গাড়িটি নিয়ে বের হলে আমরা সে ব্যবস্থাও নিচ্ছি।”
রাজপথ শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়: র্যাব ডিজি
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আবেগের সুযোগ নিয়ে ‘স্বার্থান্বেষী মহল’ তাদের ভিন্ন পথে পরিচালনার চেষ্টা করছে বলে অভিভাবকদের সতর্ক করেছেন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদও।
তিনি বৃহস্পতিবার বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই আন্দোলনে যারা এসেছে, তারা অবোধ শিশু ছাত্র। এটা তাদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। আমরা তাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছি। শিক্ষার্থীদের আবেগকে আমরা এপ্রিসিয়েট করছি।”
স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী পুরো বিষয়টিকে ‘ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করছে’- এই দাবি করে তিনি বলেন, “আমি প্রত্যেক অভিভাবককে আহ্বান জানাব, তারা যেন কোনো অপচেষ্টা করতে না পারে, কোনো সুযোগ না পায়।”
গত পাঁচ দিনের আন্দোলনের মধ্যে দুদিন ধরে ‘সুবিধাভোগী গোষ্ঠী’র তৎপরতা দেখার কথা বলেন র্যাবের মহাপরিচালক।
“তারা নিষ্পাপ শিশুদের ভিন্ন পথে পরিচালনার চেষ্টা করছে। তারা পরিবহন ব্যবস্থা অচল করে দিয়ে ঢাকার মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে।”
গত পাঁচ দিনে ঢাকায় ৩ শতাধিক বাস ভাংচুরের তথ্যও জানান তিনি।
অভিভাবকদের সতর্ক করে বেনজীর বলেন, “অভিভাবকদের অনুরোধ করব, নিরাপত্তার স্বার্থে আপনার সন্তানকে রাস্তা থেকে সরিয়ে নিন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে যারা রয়েছেন, স্কুল পরিচালনা কমিটিতে যারা রয়েছেন তাদের এবং শিক্ষকদের বলব, নিজ দায়িত্বে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে নিয়ে যান।”
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি কার্যক্রম চলছে বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেন তিনি। ফেইসবুকসহ ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত কোনো গুজবে কান না দিতেও তিনি অনুরোধ করেছেন।