ঢাবির ‘নিপীড়নবিরোধী’ শিক্ষকদের কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন ‘সচেতন’দের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে কর্মসূচি পালনকারীদের নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আরেক দল শিক্ষক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2018, 11:29 AM
Updated : 22 July 2018, 12:45 PM

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত করার অপপ্রয়াস’র প্রতিবাদে রোববার কলাভবনের সামনে ‘সচেতন শিক্ষক সমাজ’ ব্যানারে এক মানববন্ধন থেকে এই প্রশ্ন তোলা হয়।

কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, “কোটা আন্দোলনের নামে ও নিপীড়নের নামে মুক্তিযুদ্ধের উপর আঘাত কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।”

সরকারি চাকরিতে কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবিতে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় হামলার প্রতিবাদে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে একদল শিক্ষার্থী কর্মসূচি পালন শুরুর পর ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে একদল শিক্ষকও সরব হন।

গত কয়েকদিনে এই শিক্ষকদের কর্মসূচি থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারীদের শাস্তি না হওয়ায় উপাচার্য, প্রক্টরসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কড়া সমালোচনা করা হয়। তারা কোটা সংস্কারের দাবিতেও সমর্থন জানান।

এর পাল্টায় ‘সচেতন শিক্ষক সমাজ’ ব্যানারে সক্রিয় হলেন আরেক দল শিক্ষক; যাদের নেতৃত্বে দেখা গেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের শিক্ষকদের।

বৃষ্টির কারণে অপরাজেয় বাংলা থেকে কলাভবনের ফটকে স্থানান্তরিত তাদের কর্মসূচিতে বিভিন্ন বিভাগের শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন।

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখরের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছাড়াও বক্তব্য রাখেন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম, কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমান, শামসুন্নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া সাহা, শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক তাজিন আজিজ চৌধুরী প্রমুখ।

মানববন্ধনে বক্তাদের কয়েকজন বলেন, কোটার যৌক্তিক সংস্কার তারাও চান। তবে কেউ কেউ এ নিয়ে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করতে চাইছেন।

‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক’দের কর্মসূচিতে দেওয়া বক্তব্যের জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আকমল হোসেনের শাস্তি দাবি করেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল।

তিনি বলেন, “সেই সমাবেশ তাদের ভাষায় ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে। সেই সমাবেশ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের বিরুদ্ধে। অপ্রাসঙ্গিকভাবে সেখানে দাঁড়িয়ে যখন বলা হয়- ‘শেখ হাসিনা কি মুক্তিযুদ্ধ করেছে? শেখ মুজিব কি মুক্তিযুদ্ধ করেছে?

“বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করা মানে এদেশের জাতির অস্তিত্বের উপর আঘাত করা, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আঘাত করা, স্বাধীনতার উপর আঘাত করা। আইয়ুব, ইয়াহিয়া যে কাজটি করেনি, রাজাকার যে কাজটি সাহস করে নাই, আজকে তিনি (আকমল) তার যৌবনে মুক্তিযুদ্ধে যান নাই, তিনি আজকে বঙ্গবন্ধুকে এখানে দাঁড়িয়ে আঘাত করছেন। আয়োজকরা ক্ষান্ত থাকছেন, সামনে যাদের বসিয়ে রাখা হচ্ছে, তারা আবার হাততালি দিচ্ছেন। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এই চিত্র আমাদের দেখতে হচ্ছে।”

অধ্যাপক আকমলের বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিতেও উত্থাপন করা হবে জানিয়ে সমিতির সভাপতি বলেন, জাতির জনককে নিয়ে প্রশ্ন তোলার মধ্য দিয়ে  তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে। 

“এখান থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় পুরো দৃশ্যপট। একটা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়কে টেনে এনে বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করা হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করা হচ্ছে। এটা কীসের আলামত, সেটা আপনাদেরও বুঝতে বাকি নেই, আমাদেরও বুঝতে বাকি নেই।”

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের প্রতি শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সংহতি প্রকাশের কথা তুলে ধরে মাকসুদ কামাল বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কোটা বিষয়ে একটি যৌক্তিক ও আইনি সমাধান হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সেটি হয়ত সময়ের ব্যাপার।”

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “কোটা সংস্কার যৌক্তিক দাবি, আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি। যারা এই আন্দোলনটি করছে, তাদের সাথে হয়ত আমাদের কোনো জায়গায় একটি কমিউনিকেশন গ্যাপ হচ্ছে। আমাদের ব্যাখ্যা করতে হবে কয়টা ক্যাডার সার্ভিস, নন ক্যাডার, কারা কিভাবে কোন শ্রেণিতে আসতে পারে।

“মাত্র দুই থেকে তিন হাজার যেখানে নিয়োগ পাচ্ছে, তাহলে কেন এই আন্দোলনটিকে আমরা গতিশীল করে কেন ইস্যু ক্রিয়েট করছি? অর্থাৎ এখানে নিশ্চয়ই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার পাঁয়তারা কেউ না কেউ করছে।”

অধ্যাপক তাজিন আজিজ চৌধুরী অভিযোগ করেন, ‘নিপীড়নবিরোধী’ শিক্ষকদের সমাবেশে অংশ না নেওয়া শিক্ষকদের ‘মেরুদণ্ডহীন’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।

“তাদের এই অধিকারটা নাই যে আমাদের বাকিদেরকে বলা- তোমরা মেরুদণ্ডহীন, তোমরা এই, তোমরা সেই। আমাদের মিডিয়াতে ইনসাল্ট করা কিংবা হিউমিলিয়েট করার অধিকার তাদের কেউ দেয়নি। তাদের যেমন অধিকার আছে তাদের মতামত ব্যক্ত করার, আন্দোলন করার, আমাদেরও অধিকার আছে তাদের সঙ্গে সেখান শামিল না হওয়ার।”

অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা বলেন,  “আমি কবি সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট, আমাদেরকে নিয়েই প্রথম ষড়যন্ত্র রচনাটি হয় কোটা সংস্কার নিয়ে। সব কিছুই গুজব, পরবর্তীতে আমরা জানতে পারলাম।

“বিষয়টি হল মাননীয় উপাচার্য শিক্ষকবান্ধব, শিক্ষার্থীবান্ধব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার চেষ্টা করছেন, সেজন্য তার উপর যখন প্রাণনাশের চেষ্টা হয়েছে, তখনও কিন্তু তিনি পুলিশ বাহিনী কিংবা কারও আশ্রয় নিতে চান নাই।

“তিনি বিশ্বাস করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিয়ে তার কোনো ক্ষতি হতে পারে না এবং পরে দেখলামও তাই। কতিপয় অছাত্ররা এটার সাথে সংশ্লিষ্ট আছে।”

ক্লাস-পরীক্ষা সচল রাখতে সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সকলের পক্ষ থেকে বলছি, আমাদের ক্লাস নেওয়ার পরিবেশ, আমাদের ছাত্রদের ক্ষতি হয় এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করবেন না, আপনারা পারবেন না।”

অধ্যাপক সুপ্রিয়া সাহা বলেন, “আমরা সবাই একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত, সেটা হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ৷ অনেক কষ্ট করে সেশনজট দূর করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে চলছে ৷

“সেখানে একটি অপশক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থির করতে চাইছে ৷ কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থির করতে পারলে দেশ অস্থির হয়ে যাবে৷ সেজন্য আমার ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের কাছে অনুরোধ, আমরা কোনোভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট হতে দেব না। আর সেশনজ্যাম ঢুকতে দেব না।”