তারা বলছেন, পাসের হার বাড়তে বাড়তে মান নিয়ে যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, প্রশ্নফাঁসের বিস্তারে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যে অনাস্থা তৈরি হচ্ছিল, এবারের ফলাফলে সেসব কাটিয়ে ইতিবাচক ধারায় ফেরার আভাস তারা পাচ্ছেন।
আর অনেক চেষ্টার পর পাবলিক পরীক্ষায় কার্যকরভাবে প্রশ্নফাঁস ঠেকানো সম্ভব হওয়ায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের কথায় প্রকাশ পেয়েছে স্বস্তি।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এইবার পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ক্রটির বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেউ কোথাও উত্থাপন করেননি। এইবারের পরীক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো সুযোগ কারো ছিল না, কেউ করেনি।”
উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় এবার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৯ হাজার ২৬২ জন।
গত বছর এ পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৩৭ হাজার ৭২৬ জন।
শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে এবার পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোয় এবং অভিন্ন প্রশ্নে সারা দেশে এমসিকিউ অংশের পরীক্ষা হওয়ায় ফলাফলে প্রভাব পড়েছে।
তবে একে খারাপ ফলাফল বলতে রাজি নন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তার ভাষায়, পাসের হার কিছুটা কমে ধীরে ধীরে ‘স্থিতি’ পাচ্ছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল পৃথিবীর সর্বত্র ওঠানামা করে, এটা সর্বত্র বাড়তে থাকে না। আগে আমাদের একটা অস্বাভাবিক ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছিল… এখন এটা স্ট্যাবিলাইজড হচ্ছে।”
ব্যবস্থাপনায় কড়াকড়ি
গত কয়েক বছর ধরে পরীক্ষার আগের রাতে ও পরীক্ষা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ফেইসবুক ও ম্যাসেঞ্জারে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য হয়ে উঠেছিল বড় দুশ্চিন্তার কারণ।
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ১৭টি বিষয়ের মধ্যে ১২টির এমসিকিউ অংশের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল বলে সরকারের তদন্ত কমিটি প্রমাণ পায়।
এই প্রেক্ষাপটে কঠোর সমালোচনার মুখে এবার উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজায় সরকার। প্রশ্ন ফাঁসের কোনো অভিযোগ ছাড়াই শেষ হয় পরীক্ষা।
বৃহস্পতিবার সকালে ফলাফল হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে নেওয়া উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে এখন যেভাবে এ পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেই সময় কমিয়ে আনা গেলে পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে ‘গুজব ও অপপ্রচারও’ কমে আসবে।
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সার্বিকভাবে ফলাফলে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা যে একটা গুণগত পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছি এটা তার একটা সূচনা।”
তিনি জানান, ঢাকা বোর্ডে এবার আইসিটিতে ৮২ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, গতবার যা ৮৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল।
গত বছর পদার্থ বিজ্ঞানে ৯২ দশমিক ১৭ পাস করলেও এবার করেছে ৮৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। উচ্চতর গণিতে গতবার পাসের হার ছিল ৯৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ, এবার ৮৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
জিয়াউল হক বলেন, “পরীক্ষার ব্যবস্থাপনা গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার অনেক ভালো ছিল, এ কারণে পাসের হার কিছুটা কমতে পারে।
>> পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষার হলে গিয়ে সিটে বসা।
>> ট্রেজারি থেকে সব সেট প্রশ্নের প্যাকেট পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে কেন্দ্রে আনা।
>> ট্রেজারি থেকে তিনজন কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রশ্ন কেন্দ্রে পৌঁছানো।
>> বিশেষ নিরাপত্তা খামে প্রশ্ন সংরক্ষণ।
>> পরীক্ষা শুরুর ২৫ মিনিট আগে এমএসএসের মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্নের সেট নম্বর জানানো।
>> পরীক্ষার সময় পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বোর্ড, জেলা ও মাঠ প্রশাসনের ভিজিল্যান্স টিমের কঠোর নজরদারি।
কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, উচ্চ মাধ্যমিকে এবার সব বোর্ডে আলাদা প্রশ্নে রচনামূলক অংশের পরীক্ষা হলেও এমসিকিউ পরীক্ষা হয়েছে অভিন্ন প্রশ্নে।
জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমার পেছনে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তার।
এর ফলে এখন আগের চেয়ে ‘ভালোভাবে’ উত্তরপত্র মূল্যায়ন হচ্ছে বলে মনে করছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের এই নির্বাহী পরিচালক।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “পাসের হার যেভাবে বাড়ছিল তা নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ ছিল। আর পরীক্ষার মার্কিংও খুব সহজভাবে হচ্ছিল।
“পাসের হার বাড়া নিয়ে উদ্বেগ ছিল। কারণ একটা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে বেড়ে যাওয়া এক জিনিস, আর নানা ধরনের গলদের কারণে ফলাফল হওয়া অরেক জিনিস।”
হোসেন জিল্লুরও মনে করেন, ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নতি হওয়ার এবার উচ্চ মাধ্যমিকে পাসের হারে এই পরিবর্তন এসেছে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে মানসম্পন্ন শিক্ষার চ্যালেঞ্জ এখন অন্যতম। শুধু পাসের হার নিয়ে নয়, শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনা, শিক্ষকদের মান- এসব সূচকও দেখতে হবে।”
এক নজরে ফলাফল
বোর্ড | পাসের হার (%) | জিপিএ-৫ (জন) | পাসের হার (%) | পাসের হার (%) |
| ২০১৮ | ২০১৮ | ২০১৭ | ২০১৬ |
ঢাকা | ৬৬.১৩ | ১২,৯৩৮ | ৬৯.৭৪ | ৭৩.৫৩ |
রাজশাহী | ৬৬.৫১ | ৪,১৩৮ | ৭১.৩০ | ৭৫.৪০ |
কুমিল্লা | ৬৫.৪২ | ৯৪৪ | ৪৯.৫২ | ৬৪.৪৯ |
যশোর | ৬০.৪০ | ২,০৮৯ | ৭০.০২ | ৮৩.৪২ |
চট্টগ্রাম | ৬২.৭৩ | ১,৬১৩ | ৬১.০৯ | ৬৪.৬০ |
বরিশাল | ৭০.৫৫ | ৬৭০ | ৭০.২৮ | ৭০.১৩ |
সিলেট | ৬২.১১ | ৮৭৩ | ৭২.০০ | ৬৮.৫৯ |
দিনাজপুর | ৬০.২১ | ২,২৯৭ | ৬৫.৪৪ | ৭০.৬৪ |
মাদ্রাসা | ৭৮.৬৭ | ১,২৪৪ | ৭৭.০২ | ৮৮.১৯ |
কারিগরি | ৭৫.৫০ | ২,৪৫৬ | ৮১.৩৩ | ৮৪.৫৭ |
ডিআইবিএস (ঢাকা) | ৮৭.৮২ | ০০ | ৭১.৫৮ | ৮১.৪৬ |
মোট | ৬৬.৬৪ | ২৯,২৬২ | ৬৮.৯১ | ৭৪.৭০ |
কুমিল্লার বিপরীতে দিনাজপুর
গত বছর ফল বিপর্যয় হলেও এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু দিনাজপুরে পাসের হার নেমে গেছে সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
কুমিল্লা বোর্ডে গতবছর মাত্র ৪৯ দশমিক ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে, যা টেনে নামিয়েছিল সারা দেশের পাসের হার। ধাক্কা সামলে এবার এ বোর্ডের ৬৫ দশমিক ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে; তাদের মধ্যে ৯৪৪ জন পেয়েছে জিপিএ-৫।
কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আসাদুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গতবারের বাজে ফলের পর প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে কর্মশালা করে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বোর্ডে গত বছর ইংরেজিতে পাসের হার ছিল ৬২ শতাংশ, এবার তা বেড়ে ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ হয়েছে। বাংলায় পাসের হার ছিল গতবারের ৯১ শতাংশ থেকে বেড়ে এবার ৯৫ শতাংশ হয়েছে।
রসায়নে গতবার যেখানে ৮৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল, এবার পাস করেছে ৯৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী। আর জীব বিজ্ঞানের পাসের হার গতবারের ৮৩ দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হয়েছে।
কুমিল্লা বোর্ডে সব বিষয়েই পাসের হার বেড়েছে জানিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেন, “অঞ্চলভিত্তিক তারতম্যের কারণে পাসের হার কিছুটা কম হয়েছে। বোর্ডের সব জেলার পাসের হার একই রকম হলে সার্বিক অবস্থার আরও উন্নতি দেখা যেত।”
গতবছর দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ছিল ৬৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর দুই হাজার ৯৮৭ জন জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তোফাজ্জুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বোর্ডে এবার ইংরেজিতে অকৃতকার্য হয়েছে ৩৯ হাজার ৪৫০ জন। এর ফলে এই ফল বিপর্যয় হয়েছে। তাছাড়া খাতা দেখায় ‘কড়াকড়ি’ বাড়াও ফল খারাপ হওয়ার একটি কারণ।”
মূল্যায়ন ‘সঠিক পথে’
এইচএসসিতে ঢাকার নটরডেম কলেজের পাসের হার এবার ৯৯ শতাংশ; তিন হাজার ৮৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে দুই হাজার ৬৯ জন।
দেশের নামি এই কলেজের ফলাফলে এবার তেমন কোনো তারতম্য না ঘটলেও সারা দেশের ফলাফলে পাশের হার কমে যাওয়াকে ‘স্বাভাবিক ও ইতিবাচক’ প্রবণতা বলে মনে করছেন অধক্ষ্য ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গত কয়েক বছরে যে প্রশ্ন ফাঁস, নকল এসবের কালচার গড়ে উঠেছিল এবছর তার ব্যতিক্রম ঘটল। আমার মনে হয় এ বছর খাতার মূল্যায়নও ভালো হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই যে রেজাল্ট, আমি মনে করি এটাই বাস্তবসম্মত রেজাল্ট। স্বচ্ছ পরীক্ষা এবং স্বচ্ছ তার ফলাফল। স্টুডেন্টরা এভাবেই বুঝতে পারবে লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই।”
ঢাকার আরেক নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মতিঝিল আইডিয়াল কলেজের পাসের হার গতবছরের তুলনায় কমেছে বলে জানান অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। তবে সারা দেশের তুলনায় এ কলেজের শিক্ষার্থীরা ভালো করায় কর্তৃপক্ষ খুশি।
মতিঝিল আইডিয়ালের ১১৫৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে এবার পাসের হার ৯৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৬২ জন।
অধ্যক্ষ বলেন, “হয়ত আগে লিবারেলি খাতা দেখত, অনেক কিছু ওভারলুক করে যেত, এবার যায়নি। এটা ভালো হয়েছে, মূল্যায়ন সঠিক হয়েছে।”
একই ধরনের মত প্রকাশ করেন ঢাকার রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও বাংলা বিভাগের প্রধান মো. সুলাইমান কবির।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ায় এবার শিক্ষার্থীদের আনন্দটা দ্বিগুণ হয়েছে। রেজাল্ট যাই হোক, প্রকৃত মূল্যায়নে সবাই খুশি। প্রশ্ন ফাঁস হলে তো মেধার মূল্যায়নটা হয় না; ওই প্র্যাকটিসটাও খারাপ।”
এবার প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো সম্ভব হওয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ‘নেতিবাচক ধারণারও পরিবর্তন’ আসবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
সুলাইমান কবিরের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল রাজউক উত্তরা মডেল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পাওয়া ইমরানের কথায়।
“এবার প্রশ্ন কিছুটা কঠিন হয়েছে। অনেক ভয় লাগছিল, কিন্তু ভালোও লাগছিল। অন্যবার শোনা যায় অনেকে অনেকভাবে জিপিএ ৫ পাচ্ছে। কিন্তু এবার তেমন হওয়ার সুযোগ নেই। তাই রেজাল্টে অনেক বেশি খুশি।”
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে এবার পাসের হার ৯৯.৯৪ শতাংশ; ১৫৩৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৫৫ জন।