সহপাঠিনীর ‘রাগের’ পরিণতিতে হাসপাতালে ঢাবি ছাত্র

দুজনই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনার শিক্ষার্থী; বন্ধুও ছিলেন তারা, বলছেন সহপাঠীরা; কিন্তু এখন দুজন অনেকটাই শত্রুতার সম্পর্কে।

তারেক হাসান নির্ঝর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2018, 05:44 PM
Updated : 19 July 2018, 12:07 PM

এই দুজনের একজন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র শেখ আল আমিন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে; পেটানো হয়েছে তাকে। আল আমিনের দাবি, তার ওই সহপাঠী ‘অন্যদের দিয়ে তাকে পিটিয়েছেন’।

দুজনের অন্যজন রিফাত বেলায়েত অস্বীকার করেছেন পেটানোর অভিযোগ। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ‘ভাব নেয়’ বলে আল আমিনের উপর ভীষণ রাগ তার।

আল আমিনের উপর হামলায় জড়িতদের শাস্তি দাবিতে তার সহপাঠীরা বুধবার উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে অবশ্য ছিলেন না রিফাত।

অন্যদিকে রিফাত আবার নিজের নিরাপত্তা চেয়ে প্রক্টরের কাছে একটি আবেদন করেছেন।

মাথা ও স্প্যাইনাল কর্ডে জখম নিয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী আল আমিন এখনও কোনো অভিযোগ না দিলেও বিষয়টি গোচরে এসেছে প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানীর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখেছি, এটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তাই আমরা তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি।”

বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হবিগঞ্জের গরিব ঘরের সন্তান আল আমিনের সঙ্গে প্রথম বর্ষেই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় অবস্থাপন্ন ঘরের রিফাতের। তাদের মধ্যে ‘প্রেম’ ছিল বলেই মনে হয়েছে অন্য সহপাঠীদের।

তবে এক বছর আগে দুজনের সম্পর্কে ফাটল দেখেন সহপাঠীরা। এরপর নানা সময়ে আল আমিনের সঙ্গে রিফাতকে দুর্ব্যবহার করতেও দেখেছেন তারা। এই কারণে বিভাগের এক শিক্ষক তাদের দুজনকে মৌখিকভাবে  একে অন্যের সঙ্গে মিশতেও মানা করে দিয়েছিলেন।

এরপর গত সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘটে আল আমিনের উপর হামলার ঘটনা। সূর্যসেন হলের ব্যাডমিন্টন কোর্টের সামনে আল আমিনকে বেদন পেটায় কয়েকজন। তখন রিফাতও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

আহত আল আমিন এখন হাসপাতালে

আল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ভালো ফ্রেন্ড ছিলাম। তবে একটা সমস্যার পর থেকে আমি আর ওর সাথে কথা বলি না। ও আমাকে প্রায়ই মারার হুমকি দিত।”

সম্পর্কে ফাটল ধরার বিষয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, “ও পরীক্ষার শিটের জন্য, ক্যাম্পাসে ঘোরার জন্য আমার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখত বলে আমার মনে হয়েছে। ও আমাকে বলত, আমাকে নাকি পছন্দ করে; আবার অন্য ছেলের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখত। তাই আমি সরে যেতে চেয়েছি।”

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আল আমিন বলেন, “সোমবার সন্ধ্যার পর আমি সামাজিক বিজ্ঞান চত্বরে টিবারিও নামে আমার এক রোমানিয়ান ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এমন সময় অপরিচিত একটা নম্বর থেকে ফোন আসে, বলে ‘ভাই আমি আরিফ, আপনার হলের ছোটভাই। আপনি কোথায়?' আমি উত্তর দেই। সে জানায়, সে আমার সাথে দেখা করতে আসবে। কিন্তু আসেনি।

“কিছুক্ষণ পর আমি আমার ওই বিদেশি বন্ধুকে আমার সূর্যসেন হল দেখাতে নিয়ে যাই। ব্যাডমিন্টন কোর্ট পর্যন্ত আসলে দুটি মোটর সাইকেল আমার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং পথরোধ করে। এরপর রিফাত সেখানে এসে আমাকে দেখিয়ে দেয়। প্রায় ১৫ জন ছিল ওর সাথে। আমাকে ওরা কিল-ঘুষি মারতে মারতে মাথায় আঘাত করা শুরু করে। এক পর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। কারা আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে, তাও জানতাম না।”

আল আমিনের ফোনবুকে দেখে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, যে নম্বর থেকে তাকে ফোন দেওয়া হয়েছিল সেদিনতা ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আমজাদ মঞ্জুর।

আমজাদ মঞ্জু সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের উপ ছাত্র ও ছাত্র-বৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক। তিনি হল ছাত্রলীগের সভাপতি সারোয়ার সারো'র অনুসারী। সারোয়ার তার কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সবার সামনেই বলেন, আল আমিনের বাসা হবিগঞ্জ বলে তিনি সিলেট যাওয়ার বিষয়ে তথ্যের জন্য ফোন দিয়েছিলেন।

তবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় আমজাদ দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য।

তিনি বলেন, রুমমেট এক ‘বড় ভাই’য়ের কথায় তিনি আল আমিনকে সেদিন ফোন দিয়েছিলেন।

“রুমমেট ভাই বলল, তাই ফোন করে উনাকে (আল আমিন) হলে আসতে বলেছি।”

দুই জায়গায় দুই তথ্য দিচ্ছেন কেন- এ প্রশ্নে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মঞ্জু।

আমজাদ মঞ্জুর ওই রুমমেট তামজীদ হোসেন তামিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক৷ তিনি ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী।

হামলাকারী হিসেবে আরও একজনের নাম বলছেন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তিনি মাস্টারদা সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী এম এইচ পারভেজ।

তাদের সবার বাড়িই নোয়াখালী জেলায়। এর মধ্যে পারভেজ নোয়াখালী ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সাধারণ-সম্পাদক, তামজিদ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, মঞ্জু আইসিটি বিষয়ক সম্পাদক এবং রিফাত বেলায়েতও এই সংগঠনে সক্রিয়।

আমজাদ মঞ্জু জেলা সমিতির কল্যাণে রিফাতকে চেনেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন। তবে রিফাত বলছেন, তিনি আমজাদ মঞ্জুকে চেনেন না।

আর পারভেজ বলছেন, রিফাত তার বন্ধু হলেও ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই।

"আমি তখন হলে ঘুমাচ্ছিলাম। রিফাত আর আল-আমিন দুজনেই আমার বন্ধু। আমি এই ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। পরে জানতে পেরে আল-আমিনকে হাসপাতালে দেখতে গেছি।"

ঘটনার প্রেক্ষাপট জানতে চাইলে রিফাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক বছর আগে আল আমিন আমার বাসায় এসে আমাকে মারছিল। আমি তাকে আটকাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার মা তাকে ছেড়ে দেয়। তার প্রতি আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। আমি যখনই তার কাছে কিছু বলতে যাই, সে আমাকে অপমান করে, প্রচণ্ড অপমান করে, টিজ করে, আমার রাগ আরও বেড়ে যায়।”

ঘটনার দিনের বর্ণনায় রিফাত বলেন, “সেদিন ও (আল আমিন) আগে ক্লাসে আসে, আমি পরে আসি। আমি চাই সে আমার প্রতি নত থাকুক, কিন্তু সে এমন মুখভঙ্গি করে যে আমার রাগ আরও বেড়ে যায়। সেদিন রাতে তার সাথে আমার শ্যাডোতে দেখা হয়। আমি ওকে বলি, তুই আমার সাথে এমন করিস কেন?

“এরপর কথা কাটাকাটি হয়। সে আমার দিকে তেড়ে আসে। আমি চিৎকার করি তখন আশেপাশের ছেলেরা এসে ওকে মারছে। আমি ছিলাম ওখানে।”

আল আমিনের উপর হামলাকারীদের কাউকে চেনেন না বলে দাবি করেন রিফাত।

ঘটনা শ্যাডোর হলে সূর্যসেন হলের ব্যাডমিন্টন খেলার স্থানে কেন গেলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যাব না? সে আরেকটা ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল। তাকে দেখলেই আমার রাগ লাগে।”