‘ছাত্রলীগের ত্রাসে শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে দাঁড়াতেও ভয় পায়’

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের মারমুখী আচরণের নিন্দা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলেছেন, তাদের কারণে এখন শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে কর্মসূচি পালন করতেও ভয় পায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 July 2018, 04:48 PM
Updated : 18 July 2018, 05:26 PM

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলায় জড়িতদের শাস্তি, গ্রেপ্তারদের মুক্তি এবং নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক মানববন্ধনে নিয়ে একথা বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর অংগ্রহণে এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রুশাদ ফরীদি।

তিনি মানববন্ধনে বলেন, “ক্যাম্পাসে আগে ছোট ছোট বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা মানববন্ধন করত। সেই ছাত্র-ছাত্রীরা এখন শহীদ মিনারে দাঁড়াতেও ভয় পায়। ছাত্রলীগের যে ত্রাসের রাজত্ব চলছিল, সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় শহীদ মিনারে দাঁড়াতে ভয় পায়।”

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, “এখানে কিছু বহিরাগত থাকলেও অধিকাংশ আমাদের ছাত্র। তারা কেন এমন করেছে জানতে চাইলে তারা বলছে, কোটা আন্দোলনে জামাত-শিবির আছে, ইন্ধন যোগাচ্ছে বিএনপি, ভিসির বাড়িতে হামলাকারীরা আছে। আমি তাদের বলেছি, ভিসির বাড়িতে হামলা অপরাধ। তাদের প্রমাণসহ ধরা হোক। কিন্তু কোনো প্রমাণ ছাড়াই ছাত্রদের ধরে নিয়ে রিমান্ডে দেওয়া হচ্ছে।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গণরুমের’ সংস্কৃতির সমালোচনা করে ছাত্র সংগঠনের ‘ক্যাডার’ তৈরির জন্য ওই বিষয়কে দায়ী করেন ড. রুশাদ ফরীদি।

মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থী বক্তব্য দেন। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আনতারা ইসলাম বলেন, “আজকে যদি এই মুহূর্তে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করি তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম চিন্তা করবে, বাংলাদেশের মতো একটা গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে কীভাবে আমরা বাক-স্বাধীনতার অধিকার হারিয়েছি।”

প্রাণ রসায়ন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাবিনা হক লাবণ্য অনেকগুলো প্রশ্ন রেখে বলেন, “কেন আমরা নিজেদের ক্যাম্পাসে কথা বলতে ভয় পাচ্ছি? কেন আমরা নিজেদের ক্যাম্পাসে নিরাপদ নই? কেন আমাদের শিক্ষকরা নিরাপদ নন? যেই শিক্ষার্থীদের তারা বছরের পর বছর পড়াচ্ছেন তারা কেন সেই শিক্ষার্থীদের কাছে নিরাপদ নন?

“এই প্রশ্নের উত্তর যদি আমরা এখনই না পাই, এই প্রশ্নের উত্তরে যদি আমরা এখনই আন্দোলন না করি, তবে হয়ত কখনোই আমরা এ প্রশ্নের উত্তর পাব না।”

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সামিন ইয়াসার বলেন, “আমরা যে দাবি নিয়ে এখানে এসেছি, এই দাবিগুলা আমরা কার কাছে করছি? যারা ঘটনাগুলা ঘটাচ্ছে তাদের বিচার আসলে কে করবে?”

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ অভিযোগ করেন, ‘অন্যায়ভাবে’ তার সহপাঠী মশিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। 

“কোটা সংস্কার আন্দোলন কি অবৈধ আন্দোলন? মশিউর রহমান কি অপরাধ করেছে যে তাকে জেলে থাকতে হবে? মশিউরকে কি আইনিভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? তাকে হল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল। দুই দিন পর তার খোঁজ পাওয়া গেল? এই দুই দিন মশিউর কোথায় ছিল? তার ওপর কি পরিমাণ নির্যাতন করা হয়েছে বোঝাই যায়!”

মানববন্ধন সঞ্চালনা করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তৌসিফ তানজিম আহমেদ।

তিনি বলেন, অন্যান্য দাবির পাশাপাশি তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রাব্বানীকে প্রাণনাশের যে হুমকি দেওয়া হয়েছে তারও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।

“আমাদের প্রক্টর স্যারকে কীভাবে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হল, তার উত্তরও আমরা চাই।”

মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের নাহিদা সারোয়ার নিভা বলেন, “আমি কেন আমার নায্য দাবি নিয়ে দাঁড়ালে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে? আমার দাবির পক্ষে দাঁড়ালে কেন আমাকে উল্টো অভিযুক্ত করা হবে?”

বক্তব্য শেষে সমস্বরে জাতীয় সঙ্গীত গান শিক্ষার্থীরা। গত কয়েক দিন শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির পাশে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি দেখা গেলেও এদিন কেউ সেখানে ছিলেন না।

মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থীরা বসে পড়েন শহীদ মিনারের পাদদেশে। সেখানে বসে তারা ‘শিক্ষকের ওপর হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসে কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘ক্যাম্পাসের সন্ত্রাসীরা, হুঁশিয়ার সাবধান’, ‘মানুষ হ রে মানুষ হ, এবার তোরা মানুষ হ’ প্রভৃতি স্লোগন দেন।

ইতিহাস বিভাগের মানববন্ধন

কোটা আন্দোলনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী তানজির হোসেন সরকারের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে তার বিভাগের শিক্ষার্থীরা। 

সকালে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে আয়োজিত এই মানববন্ধন থেকে হামলার বিচারের পাশাপাশি নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিও জানান তারা।

দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে ওই মানববন্ধনে উপস্থিত হয়ে তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানান বিভাগের দুই সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম সাকলায়েন সাকী ও এম এ কাউসার।

এম এ কাউসার বলেন, “ধারাবাহিক নির্যাতনের সর্বশেষ পর্যায়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজকে এই মানববন্ধনে যত শিক্ষার্থী আছে তার দ্বিগুণ এটাকে সমর্থন করে। গণমাধ্যমে আজকে নির্যাতনের খবর আসছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ দিন থেকে হলে, গণরুমে, গেস্টরুমে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

“সরকার যখন বলছে, কোটা থাকবে না তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বলে কোটা থাকবে না, আবার সরকার যখন বলছে, কোটা থাকবে তখন প্রশাসনও সেই সুরেই কথা বলছে।”

মানববন্ধন শেষে একটি মৌন মিছিল নিয়ে কলাভবন এলাকা প্রদক্ষিণ করেন তারা।