রোহিঙ্গাদের নেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভব সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পরও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের গড়িমসিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2018, 10:14 AM
Updated : 17 July 2018, 01:05 PM

তিনি বলেছেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক ভঙ্গিতে কথা বলে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তারপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে মিয়ানমার শিগগিরই এ সমস্যার সমাধানে সক্রিয় হবে বলে আশা প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে ‘মিট দা প্রেস’ অনুষ্ঠানে মিয়ানমার সঙ্কটের পাশাপাশি দেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার বিষয়েও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন মন্ত্রী।

রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে গত অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা চার লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বাংলাদেশ বহন করে চলেছে কয়েক দশক ধরে। 

মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। তবে মিয়ানমার সরকার তা অস্বীকার করে আসছে।

বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সম্মতিপত্রে সই করে। এর ভিত্তিতে দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয় এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।

এরপর প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারকে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হলেও কেউ এখনও রাখাইনে ফিরতে পারেনি।

এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করলেও বাস্তবে মিয়ানমার কোনো কাজ করছে না।

আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কাজটি দ্রুত শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে গত বছরের শেষে তিনি যখন মিয়ানমারে গিয়েছিলেন, তখন সেখানে সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়। সেখানে যেসব বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়, সে অনুযায়ীই বাংলাদেশ সব কাজ করেছে।

“মিয়ানমার প্রধানের সঙ্গেও কথা বলেছি আমি। তাদের অনেক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সব সময় বলে যাচ্ছেন- রোহিঙ্গাদের নেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত নেওয়ার কোনো সিম্বল দেখতে পাচ্ছি না।”

বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের শূন্য রেখায় আটকে থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও মিয়ানমার পূরণ করেনি জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন এসেছিলেন, তিনিও বলেছেন এই ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে নিয়ে যাবেন। বাস্তবতা হল, আজ পর্যন্ত এখনও নিয়ে যাননি।”

রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে গতবছর জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া পাঁচ দফা প্রস্তাবের কথা মনে করিয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা সব সময় বলে আসছি, রাখাইনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। সেগুলোর আলোকে যদি রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা না যায়, তাহলে হয়ত তারা যাবে না।

“কারণ তাদের বাড়ি ঘর কিছু তো নাই, সব ধ্বংস করা হয়েছে। এমনটি গাছগুলোও কেটে ফেলা হয়েছে। তাদের (রোহিঙ্গা) এ দুর্বিসহ জীবনে… যদি গ্যারান্টিও না থাকে, তাহলে কীভাবে যাবে? এটা আমরা সব সময় বলে আসছি।”

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওই চুক্তি স্বাক্ষরের পর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়। জাতিসংঘের মহাসিচব আন্তোনিও গুতেরেস সে সময় বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ইউএনএইচসিআরকে সঙ্গে রাখা জরুরি ছিল বলে তিনি মনে করেন।

এরপর গত ১৩ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে ইউএনএইচসিআর। এতে মিয়ানমারে ‘অনুকূল পরিবেশ তৈরি হলে’ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সংস্থাটির সহায়তার কথা বলা হয়। পরে মিয়ানমারও ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির সঙ্গে একই ধরনের চুক্তি করতে সম্মত হওয়ার কথা জানায়।

জুলাইয়ের শুরুতে কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিজে চোখে দেখে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “আমরা মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছি। আমাদের এই চাপ আরও বাড়াতে হবে যাতে রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে কী করা উচিৎ- তা মিয়ানমার বুঝতে পারে।”

সে দিকে ইংগিত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য যা যা করা দরকার বাংলাদেশ সরকার তা করছে।… আমরা চিন্তা করছি, আন্তর্জাতিক ‍উদ্যোগে খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান করতে পারব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে কোটা সংস্কার আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা নিয়েও ‘মিট দা প্রেস’ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।

হামলাকারীদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ইউনিভার্সিটিতে পুলিশ কখনও যায় না, যতক্ষণ না ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ পুলিশকে না ডাকে। কর্তৃপক্ষ যখন ডাকে, তখন ‍পুলিশ যায়।”

এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলার কথা তোলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 

তিনি বলেন, আপনারা (সাংবাদিক) সে দৃশ্যটাও দেখেছেন, ভুলে যান কেন? ভিসির বাড়ি… আমরাওতো কোনো এক সময় ছাত্র ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন সবচেয়ে শ্রদ্ধার ব্যক্তি। তার বাড়িতে আগুন ধরিয়েছে, ভাংচুর করা হয়েছে।”

ওই ঘটনায় যারা জড়িত, পুলিশ তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছে এবং সিসি ক্যামেরার ভিডিও দেখে তাদের ধরা হচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে ও সাংবাদিককে হুমকির অভিযোগ এবং কথিত বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের কাউন্সিলর একরাম হত্যার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন সম্পর্কেও সাংবাদিকরা মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন।

উত্তরে মন্ত্রী বলেন, “আমরা সব সময় বলে আসছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা এটুকুই যে অন্যায় করবে তার বিচার হতেই হবে। সবার জন্য আইন সমান। তাকে (মিজান) বহিষ্কার করা হয়েছে এবং তদন্ত যাতে নির্ভুল হয় সেজন্য ব্যবস্থা হয়েছে।

“আমরা এ কথা বলছে পারি… তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন এবং তার যদি প্রয়োজন হয় বিচারিক… তা শিগগিরই দেখবেন। এখানে কাউকে ছাড় দিচ্ছি না, এটা জোর গলায় আমরা বলতে পারি।”

আর একরামের ঘটনা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “টেকনাফের ঘটনা এখনও তদন্ত হচ্ছে। পরিবারসহ সবার সঙ্গে কথা হচ্ছে এবং কেউ দোষী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “একদম নিশ্চিত থাকুন, ওয়ারেন্ট ছাড়া অভিযোগ ছাড়া কাউকে নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার করা হয় না। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, নিশ্চয়ই তাদের নামে ওয়ারেন্ট আছে কিংবা অভিযোগ রয়ে গিয়েছিল বহু আগের। নতুন করে বলে দিলে বা কোনো অভিযোগ করলে কাউকে ধরা হচ্ছে না বা ভবিষ্যতেও ধরা হবে না।”