‘ছাত্রলীগ কি পুলিশ? ছাত্রলীগ কি র‍্যাব?’

শিক্ষার্থীদের মারধর এবং শিক্ষক লাঞ্ছনায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘ব্যর্থ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী‘রা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2018, 12:06 PM
Updated : 16 July 2018, 12:40 PM

সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে এই দাবি তোলার পাশাপাশি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হামলা প্রতিহত করার আহ্বানও জানানো হয়।

দুপুরে তাদের মানববন্ধন শুরুর ঠিক আগে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী অন্তত ১০টি মোটর সাইকেলে করে হর্ন বাজাতে বাজাতে রাজু ভাষ্কর্য দুই বার প্রদক্ষিণ করে। পরে তারা মধুর ক্যান্টিনের দিকে চলে যান।

‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থী’দের সমাবেশ থেকে বলা হয়, ছাত্রলীগের 'অনলাইন ও অফলাইন হামলার' বিচার দাবিতে তারা মঙ্গলবার উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেবেন।

এদিকে শিক্ষক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং শিক্ষার্থী মারধরের প্রতিবাদে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এদিন ক্যাম্পাসে আলাদাভাবে মানববন্ধন করে।

গ্রেপ্তার কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদের মুক্তির দাবিতে রোববার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীদের সমাবেশে সংহতি জানাতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে হেনস্তা হন তানজিম উদ্দিন খানসহ কয়েকজন শিক্ষক।

শহীদ মিনারে কর্মসূচির পর ক্যাম্পাসে মিছিলের সময়ও চড়াও হন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তখন মারধরের শিকার হন অর্থনীতি বিভাগের দুই ছাত্র।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের উপর হামলার ঘটনাগুলো নিয়ে সমালোচনার মুখে থাকা ছাত্রলীগের নেতারা সাংগঠনিকভাবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ছাত্রলীগের নেতারা দাবি করছেন, আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভেদ থেকে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, তাতে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত থাকতে পারেন, তবে এর সঙ্গে সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই।

রাজু ভাস্কর্যের মানববন্ধনে বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাকারিয়া হোসেন অনিমেষ বলেন, “বারবার একই দাবিতে আমাদের দাঁড়াতে হচ্ছে, বারবার আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে। এর আগে আমরা প্রক্টরকে প্রশ্ন করেছিলাম, একই ঘটনা যদি আবার ঘটে, আপনি পদত্যাগ করবেন তো? আর কতবার ব্যর্থ হলে তিনি নিজেকে ব্যর্থ মনে করবেন?

“এই সন্ত্রাসীরা কি প্রক্টরিয়াল টিমের দায়িত্ব নিয়েছে? যদি নিয়ে থাকে তাহলে ওই সন্ত্রাসীদের প্রক্টরের দায়িত্ব দিন এবং আপনি ওই সংগঠনে যোগ দিন। এই ভিসি এবং প্রক্টরের যদি কোনো লজ্জা থাকে, তাহলে তারা পদত্যাগ করুক।”

কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মীম আরাফাত মানব বলেন, “ছাত্রলীগ কি পুলিশ? ছাত্রলীগ কি র‍্যাব?”

ইতি নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা আসলে কত দিন মার খাব? আমরা সংখ্যায় কমে হলেও আমদের সময় এখন মার দেবার। এর মাধ্যমে ভিসি প্রক্টরকে এটাই বোঝাবো, হয় ছাত্রলীগকে কন্ট্রোল করেন, নইলে নিজেদের দায়িত্ব ছেড়ে দেন।”

মানববন্ধনের সঞ্চালক শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের শিক্ষার্থী মেঘ মল্লার গত শনিবার ছাত্রলীগের কয়েকজনের হাতে দুই শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনা তুলে ধরে  উপাচার্য ও প্রক্টরের সমালোচনা করেন।

 তিনি বলেন, “অর্থনীতি বিভাগের ওই ছাত্রী প্রক্টর স্যারকে ফোন দিলে তিনি ভিক্টিমকে উল্টো জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি রাতের বেলা বাইরে কি করেছিলে?’ একজন প্রক্টর যখন সন্ধ্যাকে রাত বানিয়ে দেন, তখন আমরা ভীত বোধ করি। আমরা প্রক্টরের এই ধরনের কথার নিন্দা জানাই এবং তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানাই।"

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মুজিবুর রহমান শিক্ষার্থীদের কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বলেন, “ন্যায্য বিষয়ের প্রতিবাদ করতে গেলে সেখানে আবার হামলা হচ্ছে। আমি তার নিন্দা জানাচ্ছি। আমি চাই, এই আন্দোলনে যারা নির্যাতিত হয়েছে, নিপীড়িত হয়েছে, প্রশাসন তাদের দিকে দৃষ্টি দিক, পাশে দাঁড়াক।”

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মানববন্ধন

শহীদ মিনারে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খানকে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে তার বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের সামনে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকও সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।

সহকারী অধ্যাপক শেখ শামস মোরসালিন বলেন, “আমি লজ্জিত আমার পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে। আমি তানজীম স্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলাম। সেই ছাত্র হিসেবেও আমি লজ্জিত, শিক্ষক হিসেবেও লজ্জিত।

“আমার শিক্ষককে এভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। তবে আশার কথা, এত ভয়ের পরেও আমরা এক হয়েছি, আমাদের বিবেক পড়ে যায়নি।”

বিভাগের প্রভাষক লামিয়া মোমেন ও মো. আলী সিদ্দিকীও কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখেন। 

শিক্ষার্থীদের মধ্যে সানজিদা বারী বলেন, “নিরাপদ ক্যাম্পাস চাওয়া অপরাধ না। এই চাওয়াটা আমাদের সবার। তানজিম স্যার এই কাজটা করেছে। তাকে কী পরিমাণ ভয় দেখানো হয়েছে, তা সবাই  দেখেছে। আসুন আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করি।”

আরেক শিক্ষার্থী জান্নাতুল নাজনীন বলেন, “যখন আমার শিক্ষককে লাঞ্ছিত করা হয়েছে, তখন মনে হয় আমার নিরাপত্তা কোথায়? তোমার তোমাদের শিক্ষককে অপমান করছো। তোমরা একটু মানুষ হও।”

মানববন্ধন শেষে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রক্টরকে একটি স্মারকলিপি দেন।

অর্থনীতি বিভাগের মানববন্ধন

সহপাঠীর হাত ধরার ‘অপরাধে’ অর্থনীতি বিভাগের দুই শিক্ষার্থীকে শনিবার মারধরের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করেছেন বিভাগটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের সামনে আয়োজিত এই কর্মসূচি থেকে দোষীদের স্থায়ী বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়। ওই ঘটনায় তিন ছাত্রকে ইতোমধ্যে সাময়িক বহিষ্কার করেছে প্রশাসন। 

অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “আমরা ভিসি স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করবেন। আমরা তার প্রমাণ দেখতে চাই।"

অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ শফিকুজ্জামান, অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানসহ বিভাগের অন্তত তিন শতাধিক শিক্ষার্থী এই কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন।

হামলার শিকার দুই শিক্ষার্থী আসাদুজ্জামান আসাদ ও রোকেয়া গাজী লিনাও উপস্থিত ছিলেন। তারা বলেন, অন্যায়ভাবে তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা এখন ‘ট্রমায় ভুগছেন’। 

লিনা বলেন, “আমাদের ক্যাম্পাসে আমাদের উপর কেন হামলা করা হল, শুধু এটুকুর জবাব চাই।”

মানববন্ধন থেকে অবিলম্বে নির্যাতনকারীদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার ও ছাত্রত্ব বাতিল, জড়িত অন্যদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া, সব শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাসে নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।

এসব দাবি আদায়ে ৭২ ঘণ্টা ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।