ইউএস-বাংলা দুর্ঘটনা: ক্ষতিপূরণ কবে?

নেপালে দুর্ঘটনায় নিহত ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের স্বজনরা চার মাসেও জানেন না, তারা ক্ষতিপূরণ কত পাবেন, কবে পাবেন?

গোলাম মুজতবা ধ্রুব নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2018, 05:00 PM
Updated : 7 July 2018, 05:06 PM

গত ১২ মার্চ ঢাকা থেকে রওনা হয়ে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থার উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়ে ৫০ জন নিহত হন, যার ২৭ জন বাংলাদেশি।

বীমা দাবি থেকে নিহতদের পরিবার কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন, সে বিষয়ে ২ লাখ ডলারসহ নানা অঙ্কের কথা গণমাধ্যমে তখন এলেও পরে বিমানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, নিহত প্রত্যেকের পরিবার ৫০ হাজার ডলার পাবে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও পাক্ষিক মনিটর সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ যদি মন্ট্রিয়াল এগ্রিমেন্টের (কনভেনশন) আওতায় থাকত, তাহলে ২ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ পেত। এখন যে ৫০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আইন অনুযায়ী ঠিকই আছে।”

এদিকে নিহত কয়েকজনের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে তারা। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষও কোনো যোগাযোগ করছে না বলে তাদের অভিযোগ।

নিহত জান্নাতুল ফেরদৌস আঁখি মনির বাবা শফিকুল ইসলাম ও তার মা হাছিনা বেগম শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা এসবের কিছুই জানেন না।

শফিকুল বলেন, “আমরা কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাব, সেটা এত দিনেও জানি না। কেউ আমাদের কোনো খোঁজ রাখে না। কেউ কোনো যোগাযোগও করছে না।”

নিহত জান্নাতুল ফেরদৌস আঁখি মনির বাবা শফিকুল ইসলাম ও তার মা হাছিনা বেগম

স্বামীর সঙ্গে আঁখি মনি; এক দুর্ঘটনায় দুজনই মারা যান

ঢাকার রামপুরা টেলিভিশন সেন্টার থেকে কিছু দূর এগিয়ে গেলেই শফিকুল ইসলাম ও হাছিনা বেগমের ভাড়া বাসা। দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে আঁখি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ শেষ করেছিলেন। তাদের আরেক সন্তান হাসান সকিব বেসরকারি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

বিয়ের পরপরই স্বামী মিনহাজ বিন নাসেরের সঙ্গে হানিমুনে নেপাল যেতে ইউ-এস বাংলার ওই ফ্লাইটে উঠেছিলেন আঁখি মনি। দুর্ঘটনায় দুজনই মারা যান। মেয়ের শোবার ঘর এখন সেইভাবে সাজিয়ে রেখেছেন হাছিনা। হারানো মেয়েকে সেখানেই খুঁজে বেড়ান তিনি।

আঁখি মনির বাবা শফিকুল ইসলাম আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেন। সারাজীবনের সঞ্চয় তিনি সন্তানদের শিক্ষার পেছনেই ঢেলেছেন। এখন বয়স হয়েছে বলে ব্যবসায় আগের মতো সক্রিয় নন।

নিহত সাংবাদিক ফয়সাল আহমেদের ভাইও সাইফুল ইসলামও জানান, তারা ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কিছু জানেন না।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্ঘটনার পর ইউএস-বাংলা থেকে আমাদের পরিবারের কাছে ভাইয়ের মৃত্যু সনদ, ওয়ারিশান সার্টিফিকেট, ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়েছিল।

“আমার বাবা আদালতেও গিয়েছিলেন। আমাদের বলা হয়েছিল, ২০/৩০ দিনের মধ্যে ইন্সুরেন্সের টাকা পাব। কিন্তু সেটা পাইনি। সেই টাকার পরিমাণ কত, সেটাও জানি না।”

নিহত ফয়সাল আহমেদ

শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার উত্তর বড় সিধলকুড়া গ্রামের সামসুদ্দিন সরদারের ছেলে ফয়সাল বৈশাখী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। 

ইউএস-বাংলার কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মোহাম্মদ শফির বাবা খাজা গোলাম মহীউদ্দিন সাইফুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কয়েক মাস আগে বিমান সংস্থা থেকে একটি ল ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল।

“সেখানে (ল ফার্ম) গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর জানতে পারি, আমার ছেলে ক্রু ছিল বলে ৫০ হাজার ডলার এবং যাত্রী হিসেবে আরও ৫০ হাজার ডলার পাবেন। সেই টাকার জন্য আদালতে যেতে হয়েছে। তবে এখনও সেই টাকা পাইনি।”

যাত্রীদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএস-বাংলার জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্ঘটনায় নিহতরা ইন্সুরেন্স থেকে কত টাকা পাবে, সেটা জানা নেই। এটি নিয়ে ইন্সুরেন্স কোম্পানি কাজ করছে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নিহতরা তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পাবেন, এজন্য সেনাকল্যাণ সংস্থার একজন আইনজীবী বিষয়টি দেখছেন।”

ইউএস-বাংলার বীমা ছিল দেশের সেনাকল্যাণ ইন্স্যুরেন্স ও সাধারণ বীমা করপোরেশনে; আন্তর্জাতিক এভিয়েশন বীমা করা ছিল ‘কে এম দাস্তুর’ নামের ব্রিটিশ ইন্স্যুরেন্সে।

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্স্ত ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি- ছবি: রয়টার্স

উড়োজাহাজের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইউএস-বাংলাকে প্রাথমিকভাবে ৪১ লাখ ৭২ হাজার ডলার দেওয়া হবে বলে আগে জানিয়েছিল সাধারণ বীমা করপোরেশন; বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

সাধারণ বীমা করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ শাহরিয়ার আহসান তখন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, যাত্রীদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ জানতে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

ইউএস-বাংলার জিএম কামরুলের বক্তব্যের পর সেনাকল্যাণ সংস্থা নিযুক্ত এসএম অ্যাসোসিয়েটসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আল আমিন রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবার যেন ইন্সুরেন্সের টাকা পান, সেজন্য এরই মধ্যে অন্তত ১৭টি মামলা ফাইল করা হয়েছে। যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবার সরকার ঘোষিত ৫০ হাজার ডলার করে পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।”

বীমা দাবির অর্থ পেতে আদালতে মামলা নিষ্পত্তিতে এই রকম সময় লাগে জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, যাত্রীর স্বজনদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র পেতেও সময় লাগছে।

কেউ কেউ বিষয়টি জানেন না বলা হলে তিনি বলেন, “এরকম কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তা প্রসেস করব।”

নিহতের স্বজনরা আগামী মাসেই বীমা দাবির অর্থ পেতে পারেন বলে আশা প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার আল আমিন।