ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুনের চিরবিদায়

বায়ান্নোর উত্তাল একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভেঙে যে মিছিলটি প্রথম বেরিয়েছিল, সেই মিছিলের মুখ হালিমা খাতুন আর নেই।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2018, 09:29 AM
Updated : 3 July 2018, 01:50 PM

বেশ কিছু দিন রোগে ভোগার পর এই ভাষাসৈনিক মঙ্গলবার এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষকের বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

হালিমা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তা অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

প্রয়াতের একমাত্র মেয়ে আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী জানিয়েছেন, বুধবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে বিকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হবে তার মাকে।

হালিমা খাতুনের নাতনী অন্তরা বিনতে আরিফ প্রপা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত বৃহস্পতিবার গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তার নানীকে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়।

হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, রক্তদূষণের মতো নানা জটিলতা নিয়ে ইউনাইটেডে সিসিইউতে ছিলেন হালিমা খাতুন।

সেখানে মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৫৬ মিনিটে চিকিৎসকরা তার মৃত্যু ঘোষণা করেন বলে হাসপাতালের কমিউনিকেশন্স ও মার্কেটিং বিভাগের প্রধান শাগুফা আনোয়ার জানিয়েছেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, হৃদযন্ত্রে মায়ো-কর্ডিয়াল ইনফেকশনজনিত সমস্যা নিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন হালিমা খাতুন।

“তিনি মায়লোডিসপ্লাসটিক সিন্ড্রোমে ভুগছিলেন। এটি এক ধরনের ক্যান্সার, যাতে অস্থিমজ্জায় রক্ত কণিকাগুলো পরিণত হয় না, বিধায় অপরিপক্ক অসুস্থ রক্ত কণিকা রক্তে প্রবাহমান থাকে। এই সমস্যার কারণে হালিমা খাতুনের বমি ও মলের সাথে ক্রমাগত রক্ত যাচ্ছিল, পরে তিনি রক্তে ইলেক্ট্রোলাইট মাত্রার ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন।”

শাগুফা জানান, হালিমা খাতুন দীর্ঘদিন ধরে খিঁচুনী, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন।

“পরে তার শরীরে মেথিসিলিন-রেজিসট্যান্ট স্টেফিলোকোকাস অরিয়াস (এমআরএসএ) ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়, যাতে কমে যায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলেও তা আর কাজ করছিল না।”

প্রজ্ঞা লাবণী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হালিমা খাতুনের মরদেহ সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হবে ধানমণ্ডিতে নাতনীর বাসায়। পরে রাখা হবে ফ্রিজিং ভ্যানে।

“কাল (বুধবার) সকাল ১১টায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে হবে নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। পরে বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা হবে। বিকালে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার দাফন হবে।”

হালিমা খাতুন ১৯৩৩ সালের ২৫ শে অগাস্ট বাগেরহাট জেলার বাদেকাড়াপাড়া গ্রামে জন্ম নেন। তার বাবা মৌলবী আবদুর রহিম শেখ এবং মা দৌলতুন নেসা।

বাদেকাড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, মনমোহিনী গার্লস স্কুল, বাগেরহাট প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে পাঠ শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ পাস করেন।

১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডো থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি করেন তিনি। 

১৯৫৩ সালে খুলনা করোনেশন স্কুল এবং আরকে গার্লস কলেজে শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা। কিছুদিন রাজশাহী গার্লস কলেজে শিক্ষকতার পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে। এখান থেকে অধ্যাপক হিসেবে ১৯৯৭ সালে অবসর নেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে হালিমা খাতুন জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্র রাজনীতিতে; পরে বাংলা ভাষা সংগ্রামেও তিনি জড়িয়ে পড়েন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ চত্বরের আমতলায় সমাবেশে তিনি ছাত্রীদের জড়ো করায় ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম গার্লস স্কুল ও বাংলা বাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে এসেছিলেন তিনি।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৪৪ ধারা ভেঙে প্রথম বের হয় মেয়েদের দল। তার সদস্য থাকে চারজন- জুলেখা, নূরী, সেতারার সঙ্গে সারিতে ছিলেন হালিমা খাতুন।

ভাষা সৈনিকদের সেই মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। সেই মিছিলে হতাহতদের ছবি তুলে রেখেছিলেন ছাত্ররা। সেই ছবিটি তারা লুকিয়ে রেখেছিলেন হলে। পরে সে ছবিটা বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন হালিমা খাতুনরা।

ভাষা সংগ্রামে আহত ছাত্র-জনতার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। হালিমা খাতুন তার দল সংগঠিত করে চাঁদা তুলেছিলেন। পরে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত করার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেন তিনি।

হালিমা খাতুন হলের মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহরে চাঁদা তুলেছেন। লিফলেট বিলি, পোস্টার লেখা এবং মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করা ছিল হালিমা খাতুনের নিত্যদিনের রুটিন কাজ।

ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে এসব কাজ করে তিনি আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হালিমা খাতুন পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদের সংগঠিত করে ভাষা আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছেন।

ভাষা আন্দোলনে তার সেই অনন্য অবদানের জন্য শিল্পকলা একাডেমি তাকে ভাষা সৈনিক সম্মাননা প্রদান করে।

হালিমা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেছেন, “ভাষা আন্দোলনে নারীদের সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করতে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যতদিন এ জনপদে বাংলা ভাষা টিকে থাকবে, ততদিন ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুনের অবদান বাঙালি জাতি স্মরণে রাখবে।”

ভাষাসংগ্রামী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে যে কজন ছাত্রী রাজপথে নেমে এসেছিলেন হালিমা আপা তাদের মধ্যে অন্যতম। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রীদেরকে সংগঠিত করার পেছনেও তার ভূমিকা রয়েছে। ভাষা আন্দোলনে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা এ জাতি চিরদিন মনে রাখবে।”