এখনও তারা বয়ে বেড়াচ্ছেন গুলশান হামলার ক্ষত

দুই বছর আগে ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ভয়াবহ স্মৃতি এখনও তাড়া করে ফেরে প্রত্যক্ষদর্শী আর আহত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2018, 06:06 AM
Updated : 1 July 2018, 11:33 AM

চোখের সামনে রাতভর জঙ্গিদের নৃসংশতা দেখে যারা ওই বেকারি থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন, তারা জীবন-জীবিকার তাড়নায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইলেও জীবনের সেই ক্ষত যেন শুকানোর নয়। 

সে সময় হলি আর্টিজান বেকারির কুক অ্যাসিসটেন্ট শিশির বৈরাগী এখন নতুন বাজার মোড়ে রাস্তার ওপর গেঞ্জি আর রেইনকোট বিক্রি করে সংসার চালানোর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ভাই, ওই দিনটা আমি মন থেকে ভুলে যেতে চাই।” 

গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। ২০১৬ সালে ঈদ উৎসবের প্রস্তুতির মধ্যে ১ জুলাই রাতে পাঁচ তরুণ অস্ত্র হাতে ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ার পর শুরু হয় ভয়ঙ্কর নৃশংসতা।

জবাই ও গুলি করে ২০ জনকে হত্যা করে তারা, যাদের মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন বিদেশি নাগরিক। হামলার খবর পেয়ে সেখানে প্রবেশ করতে গিয়ে বোমায় প্রাণ হারান দুই পুলিশ কর্মকর্তা।     

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই হামলার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চলে আসে; তখনও অনেক অতিথি হলি আর্টিজানের ভেতরে কার্যত জিম্মি হয়ে আছেন।   

সারা রাত উৎকণ্ঠার পর সকালে শুরু হয় সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’। তাদের অভিযানের মধ্যে হামলাকারী পাঁচ তরুণ ও ক্যাফের এক পাচক নিহত হন। ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় মোট ২৪ জনকে।

ভয়ঙ্কর সেই রাতে বেকারির কয়েকজন কর্মচারীকে আটকে থাকতে হয় একটি টয়লেটের ভেতরে। কুক অ্যাসিসটেন্ট শিশির বৈরাগী তাদেরই একজন। স্ত্রী স্মৃতি বৈরাগী ও নয় বছরের মেয়ে তিশি বৈরাগীকে নিয়ে তিনি এখন নতুন বাজারে থাকেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ওইদিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারি না। গুলির শব্দ, চিৎকার আর বেকারির মধ্যে রক্ত আর লাশ… আমি ভুলতে পারি না। সেজন্য আমি এখনও স্বাভাবিক হতে পারিনি।”

হলি আর্টিজান বেকারির সীমানা দেয়াল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান।

এই ভবনেই ছিল হলি আর্টিজান বেকারি, যা এখন বেশিরভাগ সময়ই থাকে তালাবদ্ধ

ইফতারের পর রাত পৌনে ৮টার দিনে যখন হামলা শুরু হয়, বেকারির বাবুর্চি দোলোয়ার হোসেন তখন ছিলেন রান্নাঘরে। ওই এক রাতে যে বিভৎসা তাকে দেখতে হয়েছে, তা এখনও ফিরে ফিরে আসে দুঃস্বপ্নের মধ্যে। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্রথম দিকে সারারাত  দুঃস্বপ্ন দেখতাম। শুধু মারামারি, খুন, মানুষের কান্নার শব্দ পেতাম। এখন খানিকটা ভালো। পরিবার, বন্ধুরা অনেক সাহায্য করছে। কিন্তু তারপরও ওই রাতটার ভয়ঙ্কর স্মৃতি মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারি না “

জেসমিন (৪) ও ইয়াসমিন (৩) নামে দুটি মেয়ে আছে দোলোয়ারের। তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি।

“বারবার মনে হয়, এই দেশে এমন নির্মম ঘটনা যেন আর না ঘটে। কারো পরিবারের সন্তান যেন জঙ্গি হয়ে মানুষকে হত্যা না করে। আসলে সবাই সচেতন হওয়া দরকার।”

হলি আর্টিজান বেকারির কুক অ্যাসিসটেন্ট আকাশ খানও সেই রাতে কিচেনে ছিলেন। সেই স্মৃতি মনে হলে এখনও আতঙ্কে তার শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয়।   

“মনে হয়, শরীরে শক্তি পাচ্ছি না। কি যেন একটা হয়েছে, কি যেন একটা হয়ে যাবে, এরকম ভয় হয়।”

সেই ভয় কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে নিজের সঙ্গেই লড়তে হচ্ছে আকাশকে।

“দুই বছর আগে ক্যারিয়ারে যেখানে ছিলাম এখনো সেখানেই আছি। ওই ঘটনা না ঘটলে হয়তো জীবনে কিছুটা হলেও ভালো পরিবর্তন আসতে পারত। কিন্তু এখন তো অজানা এক ভয় মনকে সব সময় দুর্বল করে দেয়।”

এরা এখন স্মৃতির পাতায়; গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন তারা

২০১৫ সালের শুরু থেকে লেখক, শিক্ষক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ভিন্নমতের অনুসারী ও বিদেশিদের ওপর একের পর এক উগ্রপন্থি হামলার কারণে গুলশান এলাকায় তখন ব্যাপক নিরাপত্তার কড়াকড়ি।

তার মধ্যেই গুলির খবর আসার পর পুলিশ দ্রুতই তৎপর হয়েছিল সেই রাতে। কিন্তু ভয়াবহতার মাত্রা কোথায় পৌঁছাবে, তা তারা ধারণাও করতে পারেননি। গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন খানকে তার খেসারত দিতে হয়েছিল জঙ্গিদের বোমায় প্রাণ দিয়ে।

পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আবদুল আহাদও সেদিন জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডে আহত হন। স্প্লিন্টারে তার দুই পায়ে মারাত্মক জখম হয়।  এরপর দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু এখনও কয়েকটি স্প্লিন্টার রয়ে গেছে তার শরীরে। 

সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম, ঈদের সময় হয়ত কোনো চাঁদাবাজ হলি আর্টিজানে ঢুকেছে। জঙ্গি ঢুকেছে এটা ছিল ধারণার বাইরে।”

তিনি বলেন, “ওইদিন ছিল রমজান মাসের শেষ দিকের শুক্রবার। ইফতার শেষ করে যখন গুলশান ডিসি অফিসে বসে ছিলাম তখন রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে শুলশান থানার ওয়্যারলেসে জানতে পারলাম হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসীরা ঢুকেছে।

“তখনই গুলশান বিভাগের ডিসি মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে একটি গাড়িকে করে রওনা দেই। যেতে যেতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়। যারা টহলে ছিল, তাদের হলি আর্টিজান বেকারিতে চলে যেতে বলি। কোনো সন্ত্রাসী যেন পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সমস্ত চেকপোস্ট বন্ধ করে দিতে বলি।”

খবর পাওয়ার পর ৫/৭ মিনিটের মধ্যেই সেদিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন তারা। বেকারি থেকে কেউ পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে যেতে হবে ৭৮ নম্বর রোড দিয়ে। সে কারণে ওই রাস্তায় অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ পান অতিরিক্ত উপ কমিশনার আহাদ।

“তখন আমি কয়েকটা মোবাইল দল নিয়ে ওখানে অবস্থান নিই। মিনিট দশেকের মাথায় বেকারির ভেতর থেকে প্রথমে আমাদের দিকে গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশ প্রচণ্ড গুলি চালাতে থাকলে তারা অবরুদ্ধ হয়ে যায়।

আধা ঘণ্টার মধ্যে মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থলের কাছে পৌঁছে যান। তখনও পুলিশ সদস্যরা হলি আর্টিজানের বাইরে অবস্থান নিয়ে আছেন। ওই সময় ভেতর থেকে গ্রেনেড ছোড়া হয়। 

জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকতে গিয়ে বোমা আর গুলির মধ্যে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান।

বিকট শব্দের পর আহাদকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ওয়াহিদুজ্জামান সে সময় বুঝতে পারেন, তিনি আহত। আহাদের পরনে থাকা সাদা পায়জামা ততক্ষণে রক্তে লাল হয়ে গেছে।

আহাদকে কাঁধে তুলে ওয়াহিদুজ্জামান চার রাস্তার মোড়ে গিয়ে তুলে দেন আরেকজনের কাছে। পরে তাকে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।

সেই ঘটনা স্মরণ করে আহাদ বলেন, “গ্রেনেড বিস্ফোরণের পর বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাউদ্দিন, ডিবির এসি রবিউলসহ আমরা পড়ে যাই। যারা পেছনে ছিল তারা বেশি আহত হন। তখন সবার প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই দুজনকে সেদিন আর বাঁচানো যায়নি।”

তিনি বলেন, “পুলিশের চাকরি করি অনেক দিন, এমন ভয়াবহ ঘটনা আমি আর দেখি নাই। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত হয়েছি। শরীরে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সহকর্মীদের আহত হয়ে পরে মরতে দেখেছি। এমন ভয়ঙ্কর দিনকে মন থেকে ভুলে যেতে চাই। সবাই মিলে আমরা দেশকে জঙ্গিমুক্ত করতে চাই।”  

দুই বছর আগে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুলিশ বলেছে দীর্ঘ তদন্তে হামলার সঙ্গে জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন সময়ে নিহত হয়েছে। বাকি আটজনের বিরুদ্ধে শিগগিরই পুলিশ চার্জশিট দেবে।

গুলশান হামলার বার্ষিকীতে রোববার সকাল ১০টায় হলি আর্টিজান বেকারির সেই ভবন সবার শোক আর শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

গুলশান থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদেশি কূটনীতিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ আসছেন। সেজন্য বাড়তি নিরপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

হামলার রাতে নিহত ওসি সালাউদ্দিন ও এসি রবিউলের স্মরণে দুটি ভাস্কর্য বানানো হয়েছে, যেগুলো গুলশান থানার নিজস্ব ভবনে রাখা হবে।

গুলশান হামলার বার্ষিকীতে বিশেষ প্রতিবেদন