প্রচারের শেষ দিন রোববার পর্যন্ত যে পরিবেশ রয়েছে তা যেন ভোটের দিনেও থাকে সেই প্রত্যাশা জানিয়েছেন নগরবাসী।
এদিনও সাধ্যমত ভোটারের দ্বারে দ্বারে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা; তাদের পক্ষে মিছিল আর গণসংযোগে পুরো নগরী চষে বেড়িয়েছেন কর্মী-সমর্থকরাও।
মহানগরীতে ভোট সামনে রেখে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতি মুকুল কুমার মল্লিক বলেছেন, এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি সেটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চাইছেন তারা।
“প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে গাজীপুরে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চলেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে কোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। যা হয়েছে কেবল কথার যুদ্ধ। গাজীপুরে আগের নির্বাচনগুলোতে অতো বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। এবারও সে রকম দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
নির্বাচনে মোট সাত মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ২৫৬ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ৮৪ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থী।
মেয়রের সঙ্গে ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মহিলা কাউন্সিলর পদের এই নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন।
মেয়র পদে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির হাসান উদ্দিন সরকার।
সকাল ৯টার পর নগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের শালনায় গণসংযোগ ও পথসভা দিয়ে শেষ দিনের প্রচার কার্যক্রম শুরু করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর। এ সময় তার সঙ্গে শত শত নেতা-কর্মী নৌকা প্রতীকের মিছিল নিয়ে পথসভায় যোগ দেন।
সেখানকার প্রচারণা শেষে ১০টার দিকে নগরীর কোনাবাড়ি এলাকায় গণসংযোগ করেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
এরপর তিনি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের চান্দনা-চৌরাস্তায় পথসভা করেন। এরপর সেখানকার বিভিন্ন বিপণিবিতানে গিয়ে লিফলেট দিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন তিনি।
পরে বিকালে জয়দেবপুরে সিটির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে যান ৩৯ বছর বয়সী তরুণ রাজনীতিক জাহাঙ্গীর; যিনি ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হতে চেয়ে পরিচিতি পান।
গাজীপুরে নৌকার পক্ষে ‘জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে’ দাবি করে শালনা এলাকার পথসভায় জাহাঙ্গীর বলেন, “মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দেবেন। গাজীপুরের মানুষ আর অনুন্নয়ের পথে থাকতে চান না। প্রচারে গিয়ে দেখেছি, নারী-পুরুষ সবার স্বতস্ফূর্ত মনোভাব। আগে গাজীপুর উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছে, এ বঞ্চনা অবসানের সময় হয়েছে।”
রোববার সকালে টঙ্গীর নিজের বাসায় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু করেন বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার।
এরপর সকাল ১১টায় টঙ্গীর দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে দুপুরে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে এসে পুনরায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও পরামর্শ সভা করেন তিনি।
পরে হাসান সরকার জেলা শহরে জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কাজী মাহবুবুল হক গোলাপের বাসায় স্থাপিত নির্বাচন মনিটরিং সেল পরিদর্শন করেন। সর্বশেষ তিনি টঙ্গী এলাকায় গণসংযোগের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ শেষ করেন।
তিনি বলেছেন, প্রচারের শেষ মুহূর্তে এসেও তার কাছে পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। তবে পরিস্থিতি যাই হোক, ভোটের মাঠে থাকবেন তিনি।
৭০ বছর বয়সী রাজনীতিক হাসান সরকার বলেন, “অত্যন্ত বিশ্বস্ত বিশেষ মাধ্যমে আমি অবহিত হয়েছি, খুলনা রেঞ্জের পুলিশদের এই গাজীপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য আনা হয়েছে… খুলনায় যে কায়দায় যে কৌশলে নির্বাচন করা হয়েছে, সেভাবে এখানে সম্পন্ন করার জন্য।
“সুষ্ঠুভাবে ভোট হয়েছে বোঝানোর জন্য পুলিশের মাধ্যমে বিএনপির এজেন্টদের মধ্যে লোক ঢোকাবে। ভোট গণনা শেষ হয়ে গেলে পরে বের হয়ে যাবে।”
ব্যালটে সিল মেরে মহিলাদের মাধ্যমে ‘পাঠানোর পরিকল্পনাও’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন হাসান সরকার।
পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশের গাড়িতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোরার ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের লোকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, কাউকে নরসিংদী পাঠানো হচ্ছে, কাউকে ঢাকা, কাউকে নারায়ণগঞ্জ পাঠানো হচ্ছে। কারো এখনো পর্যন্ত হদিসই পাই নাই।
“আমি চাই, নির্বাচন করার জন্য যে নিয়মকানুন রয়েছে এই সরকারেরই করা। সেগুলো মেনে চলুক নির্বাচন কমিশন।”
হাসান সরকার নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “দেশনেত্রী জেলে আছে। দেশনেত্রীকে মুক্ত করা এবং সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করবেন। যত ঝড়-বৃষ্টি-বাধা আসুক না কেন, আপনারা ভোটকেন্দ্রে আসুন। মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। গাজীপুরবাসী ও বিএনপির নেতাকর্মীরা সেই ত্যাগ করবে।”
তবে বিএনপির প্রার্থীর এসব অভিযোগকে নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ ও সরকারকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা’ বলে উড়িয়ে দেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম।
“এত বড় একটি নির্বাচনে আমরা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কাউকে হামলা, মামলা, জিডি, তাদের কোনো প্রচার আমরা ব্যাহত করি নাই। বরঞ্চ আমি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বাসায় গিয়েছি, আমি মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে কথা বলছি। কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি-না, গণতান্ত্রিক উপায়ে কাজ করার জন্য।”
তিনি বলেন, “তারা বলেছে, আমরা নাকি তাদের পোলিং এজেন্ট দিতে বাধাগ্রস্ত করছি। ৪২৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে তাদের কোনো এজেন্ট আমরা চিনিই না। বাধা দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
“আপনার এজেন্ট নাই, এটাতো আমার ব্যাপার না, আমার পার্টির ব্যাপার না। আপনার পার্টির কর্মীরা আসে না, আমরা কী বলব? আপনার কর্মীকে আপনি বোঝান। কেন তারা থাকবে, না থাকবে তাদের বোঝান। আমরা তো চিনি না।”
গত পাঁচ বছর মেয়র পদে বিএনপি নেতা থাকায় উন্নয়ন না হওয়ার কারণে মানুষ তাকে ভোট দেবে বলে মন্তব্য করেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর।
এদিকে বহিরাগতদের সিটি এলাকায় থাকার সময় নির্বাচন কমিশন থেকে শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া থাকলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে অনেকে প্রচারণা চালিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন। ইসির নির্দেশ ভেঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করতে এসে সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
নির্দেশ অমান্য করে ভোটের প্রচার চালাতে দেখা যায় খুলনা সিটিতে নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, বিজিএমইএ‘র সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলামকেও। তবে নির্দেশ অমান্যের বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যায়নি নির্বাচন কমিশনের।