গাজীপুরে বিধি লঙ্ঘনে ‘গা’ নেই ইসির

ভোটগ্রহণের তিন দিন আগে শনিবার মধ্যরাতের মধ্যে সব বহিরাগতদের গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়ার নির্দেশনা ছিল।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2018, 06:06 PM
Updated : 24 June 2018, 06:33 PM

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে প্রশাসনের সেই নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের সমর্থনে প্রচার চালাতে দেখা গেল খুলনার নতুন মেয়র তালুকদার আবদুল খালেককে।

জাহাঙ্গীরের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে বিষয়টি ‘জানতেন না’ বলে কর্মসূচির ইতি টানতে হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে।

প্রশ্নের মুখে জাহাঙ্গীরের সংবাদ সম্মেলন ছাড়তে হয় বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলামকেও; যাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী করা হয়েছিল।

ইসির নির্দেশনা উপেক্ষার এই ঘটনাগুলোর পাশাপাশি গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার হারুন-অর রশীদের ভূমিকা নিয়ে বিএনপি প্রশ্ন তুললেও কোনো ক্ষেত্রেই ইসির পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

আগামী মঙ্গলবার গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে। তার আগে রোববার ছিল প্রচারের শেষ দিন। এ দিন প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে সরগরম ছিল রাজধানী লাগোয়া এই নগরী।

এর মধ্যেই  সকালে নগরীর চান্দনা-চৌরাস্তা মোড়ে নৌকা প্রতীকের জাহাঙ্গীরের পক্ষে ভোট চান নৌকায় ভোট করে খুলনায় বিজয়ী মেয়র তালুকদার খালেক।

তিনি গাজীপুরবাসীর উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের মনে রাখতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের রোল মডেল। গাজীপুর পিছিয়ে থাকতে পারে না। তার প্রার্থীকে ভোট দিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে আপনাদের জন্য প্রকল্প নিয়ে, টাকা নিয়ে আসতে পারবেন। আপনাদের সমস্যা সমাধান করতে পারবেন।”

সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল; কিন্তু শেষ করতে পারেননি

এরপর দুপুরে ছয়দানা এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করতে আসেন ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতা নওফেল। বহিরাগতদের বিষয়ে নির্দেশনা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তিনি বলেন, “আমরা জানতাম, ২৪ তারিখ রাত ১২টা পর্যন্ত আমি এখানে প্রচার চালানো যাবে। নির্বাচন কমিশনের এই নির্দেশনার বিষয়ে জানতাম না। আপনারা যেহেতু নজরে এনেছেন, এখন আর মতবিনিময় সভা চালু রাখা হবে না।”

এরপর বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আতিকুলকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর। বহিরাগতদের বিষয়টি আলোচনায় আসার পর আতিকসহ কয়েকজন মঞ্চ থেকে নেমে যান।

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে এলেও পরে থাকেননি আতিকুল ইসলাম

বিষয়টি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও নেতারা ‘জানতেন না’ বললেও গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জীব কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের জানান, এ বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে গত ১২ জুন।

বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বহিরাগতদের অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আওয়ামী লীগ আচরণবিধির কোনো তোয়াক্কা করছে না। নির্বাচন কমিশন বহিরাগতদের নির্বাচনী এলাকায় অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে খুলনার বিতর্কিত ভোটের মেয়রসহ কেন্দ্রীয় নেতাদেরকেও আজকেও প্রচারণা করতে দেখা গেছে।”

প্রচারের শেষ দিন রোববার টঙ্গীতে নিজের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার

ইসি কর্মকর্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহিরাগতদের এলাকা ছাড়ার বিষয়টি আচরণবিধি ও নির্বাচন বিধিতে না থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা পরিপত্রে উল্লেখ করা থাকে।

ইসির উপ সচিব ফরহাদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বহিরাগতদের এলাকা ছাড়ার বিষয়টি আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক ইসির একটা সিদ্ধান্ত, যা আইন শৃঙ্খলা বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে জারি করা হয়।”

মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র উপেক্ষিত হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ঢাকায় সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে গাজীপুরের পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, “খুব ভালোভাবে চলছে, খুব সুন্দর পরিবেশ রয়েছে। খারাপ হলে তো আমরা খবর পেতাম।”

শেষ দিনের প্রচারে নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছিল, এলাকার বাসিন্দা নয় বা ভোটার না, তাদের ২৩ জুন রাত ১২টার পূর্বেই নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করতে হবে।

ওই সময়ের পরও বাইরের নেতাদের প্রচারের বিষয়ে কথা বলতে গাজীপুরের নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডলকে বারবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি, এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি। কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

বহিরাগতদের প্রচারে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটের একদিন আগে প্রার্থীরা প্রচার শেষ করবেন। সেক্ষেত্রে অন্যদেরও অংশ নিতে তো অসুবিধা নেই।

“কিন্তু এখন তাদের পক্ষে কে কে প্রচারণা চালাচ্ছেন, কাকে কাকে আমরা বহিরাগত বলব- এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। ভবিষ্যতে পরিবর্তন আনতে হবে প্রয়োজনে।”

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে রোববার জেলা স্টেডিয়ামে ইভিএমের পরীক্ষামূলক ব্যবহার

তার আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে গিয়ে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে তাদের নানা অভিযোগ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের জানিয়ে আসেন।

বিএনপির প্রতিনিধি দলের প্রধান আবদুল মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশন ‘ভালো নির্দেশনা’ দিলেও স্থানীয় প্রশাসন উল্টো কাজ করছে।

এক্ষেত্রে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “একজন মানুষের কারণে পুরো নির্বাচন আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। সেই মানুষকে প্রত্যাহার করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের আছে, সেই ক্ষমতা আপনারা ব্যবহার করুন। আমরা সেই অনুরোধ করেছি।”

পেছনে গাড়ি, সামনে সহকর্মীদের নিয়ে রোববার হাঁটছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুনুর রশীদ। তাকে নিয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন তুলে আসছে বিএনপি

গাজীপুরে বসে সংবাদ সম্মেলন করে ধানের শীষের প্রার্থী হাসান সরকারও পুলিশি হয়রানির অভিযোগ তুলে বলেন, “আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে পুলিশের গাড়িতে দেখা যাচ্ছে। খুলনার কারচুপির অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পুলিশ সদস্যদের ইতোমধ্যে গাজীপুরের নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য আনা হয়েছে।”

নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “গাজীপুরে আমি গতকাল গিয়েছিলাম। আমি যেটা প্রত্যক্ষ করেছি, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আসলে নেতা-কর্মীরা নির্বাচনটা পরিচালনা করছে না, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এটা পরিচালনা করছেন ওখানকার এসপি। তার অধীনে যে পুলিশ ফোর্স, ডিবি আছে, তারা এটা পরিচালনা করছে।

“গতকাল যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পুলিশের গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন ওখানকার এসপির দায়িত্বটা কী ছিল? নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব কী ছিল? কেউ কি এসপিকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনার পুলিশের গাড়িতে করে সরকারি দলের প্রার্থী ঘুরে বেড়াচ্ছেন? মনে হচ্ছে প্রার্থী আওয়ামী লীগের নন, এসপি নিজেই  প্রার্থী।”

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন এ নিয়ে করার কিছু নেই। যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে না বললে আমরা কী করব?”

তিনি দাবি করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের ব্যবস্থাই নিয়েছে।

“আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। আমরা আইন মাফিক নির্বাচন করব। এখন কথা হচ্ছে, ভোটের দিন কী অবস্থা দাঁড়ায় তার উপর।”

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে টঙ্গি কলেজ গেইট এলাকার রাস্তা

তবে বিএনপি হুমকি দিয়ে রেখেছে, গাজীপুরের নির্বাচন দেখে তারা আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া-না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন।

সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে আসছে বিএনপি; এখন তা থেকেও সরে পড়ার ইঙ্গিত রোববার দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দিয়ে রেখেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেছেন, “আমরা আগেই বলেছি, গাজীপুর সিটি নির্বাচন ইসির জন্য টেস্ট কেইস। আমরা এই নির্বাচনটি দেখে আমাদের বক্তব্য রাখব।”

[এই প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতায় ছিলেন নিজস্ব প্রতিবেদক মাসুম বিল্লাহ, কামাল হোসেন তালুকদার, তারেক হাসান নির্ঝর, আলাকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন ও গাজীপুর প্রতিনিধি আবুল হোসেন]