‘এমপিপুত্রের’ গাড়িচাপায় মৃত্যু: ‘২০ লাখ টাকায়’ আপস

সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর পরিবারের মালিকানাধীন গাড়িচাপায় নিহত সেলিম ব্যাপারীর পরিবার জানিয়েছে, এমপির পক্ষ থেকে এককালীন ২০ লাখ টাকা ও মাসে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার আশ্বাসে মামলা প্রত্যাহারে রাজি হয়েছেন তারা।

গোলাম মুজতবা ধ্রুব নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2018, 11:36 AM
Updated : 24 June 2018, 12:37 PM

পাঁচ দিন আগের ওই দুর্ঘটনায় নিহত সেলিম ব্যাপারীর (৫৫) বোনের স্বামী আবদুল আলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেলিমের স্ত্রী চায়না ব্যাপারীর ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আর প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন এমপি সাহেব। ভবিষ্যতেও পাশে থাকবেন বলেছেন।”

এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, “এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। উত্তর দিতে দিতে টায়ার্ড হয়ে গেছি।”

সেলিম ব্যাপারীর পরিবারের সঙ্গে আপস বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে এই সংসদ সদস্য বলেন, “না..না.. আমি সেখানে যাইনি...।”

আবদুল আলিম বলছেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে মহাখালীর ডিওএইচএসে নাওয়ার প্রোপার্টিজের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হোসেনের উপস্থিতিতে ওই আপস বৈঠক হয়। সেলিম ব্যাপারীর পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি এমপি একরামুল করিমের পক্ষে কয়েকজন সেখানে ছিলেন।

“এমপির পক্ষে যারা এসেছিলেন, তারা আমাদের ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন। পরে এমপি সাহেবের সাথেও আমরা দেখা করেছি। ওই মামলাটি এখন আমরা তুলে নেব।”

সেলিম ব্যাপারী দুই যুগের বেশি সময় নাওয়ার প্রোপার্টিজের গাড়িচালক হিসেবে চাকরি করে আসছিলেন। গত ১৯ জুন রাতে ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে একটি গাড়ির ধাক্কায় তিনি নিহত হন। ওই রাতেই তার মেয়ের জামাই আরিফ ভূঁইয়া কাফরুল থানায় কারও নাম উল্লেখ না করে একটি মামলা দায়ের করেন।

ওই গাড়ির মালিক আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য একরামুল করীম চৌধুরীর স্ত্রী কামরুন্নাহার শিউলী। এই সাংসদপত্নী নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

দুজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন, দুর্ঘটনার সময় ওই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সাংসদপুত্র শাবাব চৌধুরী। অন্যদিকে শাবাবের মায়ের ভাষ্য, দুর্ঘটনার সময় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন তাদের একজন ড্রাইভার, শাবাব নয়।

সেই রাতে দুর্ঘটনার পর গাড়ি অনুসরণ করে ন্যাম ভবনে গিয়ে এর সঙ্গে এমপিপুত্র শাবাবের ‘সম্পৃক্ততার কথা’ জানতে পারেন শামীম আশরাফি নামে ধানমণ্ডি এলাকার এক ব্যবসায়ী। রাতেই তিনি কাফরুল থানায় গিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেদিন তিনি বলেন, “ন্যাম ভবনে প্রবেশ করার আগে গার্ডকে জিজ্ঞাসা করতেই সে জানায়, ওই গাড়িতে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিমের ছেলে শাবাব চৌধুরী আছেন।”

মোটরসাইকেল আরোহী আরেক ব্যক্তি সেদিন শামীমের মত অনুসরণ করে ন্যাম ভবনে গিয়েছিলেন। শাবাব চৌধুরীকে তিনি বলেছিলেন, গাড়িচাপায় একজনের মৃত্যুর ঘটনার ভিডিও তার মোবাইল আছে। শাবাব যেন নিহতের পরিবারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চায় এবং তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়।

“কিন্তু শাবাব তাকে বলেন, আমরা সোসাইটির কোন লেভেল মেইনটেইন করি তা তো জানো। তোমরা চলে যাও। এমনটা হতেই পারে,” বলেন শামীম।

তিনি বলেন, ভিডিও করায় ওই মটরসাইকেলআরোহীর মোবাইল ফোন শাবাব কেড়ে নেন এবং বিষয়টি চেপে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এ জন্য যত টাকা লাগে তা তিনি দিতে রাজি।

ন্যাম ভবনের ৫ নম্বর ব্লকের নৈশপ্রহরী নজরুল ইসলাম সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে ন্যাম ভবনের ৫ ও ৪ নম্বর ব্লকের মাঝামাঝি শাবাব সাহেবকে ৫-৬ জন ছেলে-মেয়েসহ দেখা যায়। সেখানে কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে মনে হয়। পরে তাদের গাড়িচালক নুরুল আমিন বলেন, তিনি সেদিন গাড়ি নিয়ে বের হননি। শাবাব সাহেব গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন।”

দুর্ঘটনার বিষয়ে নুরুল আমিন বা শাবাব চৌধুরী- কারও বক্তব্যই জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

নাওয়ার প্রোপার্টিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান গত শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, এমপি একরামুল করিম চৌধুরী বৃহস্পতিবার রাতে তাকে ফোন করে ‘সমঝোতার প্রস্তাব’ দেন।

“তিনি চান, নিহতের পরিবারের পাশে থাকার বিনিময়ে তারা কাফরুল থানায় করা মামলা প্রত্যাহার করে নেবে। ফোনে কথা বলার পর এমপি সাহেব আমার বারিধারার অফিসে লোক পাঠিয়েছিলেন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনার জন্য।”

সেলিম ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এ কারণে তার পরিবারের জন্য ৩০ লাখ টাকার একটি ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়ার প্রস্তাব সাংসদকে দিয়েছিলেন বলে জানান ইমরান।

তিনি বলেছিলেন, “টাকা পয়সা দিয়ে তো জীবনের দাম হবে না। আবার মামলা চালিয়েই বা কী হবে? পরিবারটির দিকে তাকিয়েই মূলত এমপি সাহেবের সমঝোতার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছি।”

সমঝোতার আলোচনার সময় দুর্ঘটনায় শাবাবের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ইমরান সেদিন বলেন, “এমপি সাহেব সেটা সরাসরি স্বীকার না করলেও তাদের গাড়িতেই যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এটা স্বীকার করেছেন।”

মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান গত শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তারা জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।

সেলিম ব্যাপারীর পরিবার আপসে রাজি হওয়ায় এখন মামলার ভবিষ্যত কী হবে- এই প্রশ্নে কাফরুল থানার ওসি সিকদার মোহাম্মদ শামিম রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আপসের বিষয়ে এখনও তাদের কিছু জানানো হয়নি।