বাংলা মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের পর্বতারোহী এম এ মুহিত, বাহলুল মজনু ও শায়লা পারভীন গত ১৭ মে ২৩ হাজার ১১৩ ফুট উচ্চতার লাকপা রি শৃঙ্গে পৌঁছান।
শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রেকিং ক্লাব ও স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের হাতে পতাকা প্রত্যার্পণ করেন তিন অভিযাত্রী।
সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন অ্যান্টার্কটিকা ও সুমেরু অভিযাত্রী ইনাম আল হক। অভিযানের দলনেতা এম এ মুহিত লাকপা রি অভিযানের স্লাইড দেখান। দলের অন্য দুই অভিযাত্রী বাহলুল মজনু, শায়লা পারভীন শোনান তাদের অভিজ্ঞতা।
লাকপা রি জয়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশের পর্বতারোহী দলটি গত ২৯ এপ্রিল নেপালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে। ৪ মে নেপালের রসুয়াগাড়ি সীমান্ত পার হয়ে তারা তিব্বতের ক্যারুং ও তিংরি অতিক্রম করেন।
পরে ৮ মে বেইজ ক্যাম্পে পোঁছান তারা। বেইজ ক্যাম্পে চার রাত ও মিডল ক্যাম্পে এক রাত কাটিয়ে তারা ১৩ মে প্রায় ২১ হাজার ফুট উচ্চতায় অ্যাডভান্স বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছান।
১৭ মে রাত আড়াইটার দিকে অ্যাডভান্সড বেইজ ক্যাম্প থেকে তিন শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের তিন পর্বতারোহী চূড়ান্ত –আরোহন শুরু করেন।
প্রায় ২০০০ ফুট খাড়া হিমবাহ ও পাথরের দেয়ালে আইস-অ্যাক্স, ক্রাম্পন ও জুমারের সাহায্যে কষ্টসাধ্য আরোহন শেষে ১৭ মে নেপাল সময় বিকাল ৩টায় বাংলাদেশের তিন পর্বতারোহী লাকপা রি শীর্ষে আরোহন করেন।
এম এ মুহিত বলেন, “এই অভিযানে আমরা পুরোটা সময় জুড়েই এভারেস্ট অভিযাত্রীদের সঙ্গে বেইজ ক্যাম্প ছিলাম। মিডল থেকে একেবারে অ্যাডভান্সড বেইজ ক্যাম্প অবধি এভারেস্ট সামিটের অভিযাত্রীরা আমাদের পাশেই ছিল। শায়লা ও মজনুর মনে হয়েছে, ওরা এভারেস্ট অভিযানেই আছে। প্রায় দুই-আড়াইশ শেরপা তাঁবু গেড়ে আছে।”
পুরো ট্রেইলে বরফের অনেকগুলো নদী পার হতে হয়েছে বলে জানান মুহিত।
“হিমবাহের নিচে বরফের লুকানো নদী। সেই নদী পার হতে হয়েছে, যাকে গ্লেসিয়া বলি। ১৯ হাজার ফুট উচ্চতার মিডল ক্যাম্পে যেতে রংবুক গ্লেসিয়া, খারদা গ্লেসিয়া অতিক্রম করতে হয়েছে। ১২ মে মিডল ক্যাম্পে পৌঁছে মাত্র একদিন সেখানে ছিলাম। ১৩ মে সকাল ৮টার দিকে আমরা অ্যাডভান্সড বেইজ ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
১৩ মে বিকালে মুহিত, মজনু ও শায়লারা যখন অ্যাডভান্সড বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছালেন, তখন বেশ বরফ পড়ছিল। আবহাওয়া একটু বেশি ঠাণ্ডা।
“আমাদের আগে একটা দল পৌঁছে গিয়েছিল। তারা তাঁবু রেডি করে রেখেছিল। আমরা সাড়ে ৪টায় পৌঁছালাম। দূরে লাকপা রি দেখা যাচ্ছিল। অ্যাডভান্সড বেইজ ক্যাম্প থেকে যার উচ্চতা ২১ হাজার ফুট (৬৪০০ মিটার)। অ্যাডভান্স বেইজ ক্যাম্প থেকে ডান দিকে চলে গেছে এভারেস্টের পথ, ক্যাম্প-ওয়ান নর্থ পোল, এভারেস্ট সামিট। এই অ্যাডভান্স বেইজ ক্যাম্প থেকেই ডান দিকে রংবুক গ্লেসিয়া ক্রস করে যেতে হয় লাকপা রি’র দিকে।”
অভিযাত্রীদের দল অ্যাডভান্স বেইজ ক্যাম্পে অবস্থান করে চার দিন। পরে ১৭ মে নেপাল সময় রাত আড়াইটার দিকে দাওয়া তেনজিং শেরপা, নিমা দরজি শেরপার নেতৃত্বে পথ চলা শুরু হয় তাদের।
“প্রধান শেরপা তেনজিং শেরপা পথটা দেখে আসে । এর আগে ইউরোপিয়ানদের অভিযান ব্যর্থ হওয়ায় আমরা জানতাম না, অভিযানে ঠিক কোন দিক দিয়ে উঠতে হবে।”
মুহিত বলেন, “আমরা প্রত্যেকে পরস্পরের সাথে দড়ি বাঁধা অবস্থায় ছিলাম। পথ খাড়া ছিল। বিথী পড়ে গেলে, আমরা সবাই তাকে উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভার্টিকাল ওয়েতে মেইন রোপ ধরে যাচ্ছিলাম আমরা। সামনে এল খাড়া দেওয়াল। তারপর আইস ক্রু, স্নো বার ইউজ করে আমরা ফিক্সড রোপ লাগালাম। এতে বেশ সময় লাগল।”
মুহিতদের মেইন রোপ ছিল ৩০০ মিটার। বারবার সেই রোপ খুলে আবার লাগাতে গিয়ে সামিট তিন ঘণ্টা পিছিয়ে যায় বলে জানান মুহিত।
লাকপা রি চূড়া খুব সামনে, বাকি মাত্র ১০০ মিটার। কিন্তু সামনে বাধা খাড়া দেওয়াল ‘রক পার্ট’।সেই রক পার্ট সন্তর্পনে পার হতে হয়েছে বলে জানান তিনি।
অভিযাত্রী দলের শেরপারা এই রক পার্ট ডিঙ্গিয়ে চলে গেলেন চূড়ায়।
“সামনে তখন বরফ। শেরপারা রোপটা বেঁধে দিলেন। আমরা তখন উঠে গেলাম। চূড়ায় প্রথমবারের মতো উড়ল একটি দেশের পতাকা। দেশটির নাম বাংলাদেশ।”
লাকপা রি অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে প্যারাগন এগ্রো লিমিটেড, আরলা ফুডস বাংলাদেশ লিমিটেড, এমকে এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড, আজিম গ্রুপ।সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
১৯২১ সালে ইংরেজ পর্বতারোহী জর্জ মেলোরি প্রথমবারের মতো এই শৃঙ্গ জয় করেন।মহালানগর রেঞ্জ থেকে তিনি এই পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছিলেন।