রাস্তায় হকারি করে সংসারের বোঝা টেনে চলা এই শিশুদের কাছে ঈদ আনন্দের নয়, ফাঁকা ঢাকায় কম বিক্রিতে কেমনে সংসার চলবে সেই চিন্তার ভাজ তার কপালে ফেলে এই ‘উৎসব’।
এদেরই একজন ১২ বছরের ইলিয়াস হোসেন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকেই লেখাপড়া ছাড়তে হয়েছে তাকে। যে হাতে একদিন বইয়ের জটিল অংক কষে ফেলতে পারত, সেই হাতে এখন পান-সিগারেট বেচার টাকা গোনে সে।
ঈদের ছুটিতে রোজগার নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে ইলিয়াস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাগো ভাই দুই বেলা খাওন জুটে না, তারপর আবার ঈদ। ঈদ বড় ঝামেলা ভাই। ঢাকায় মানুষ বেশি থাকলে আমার রোজগার বেশি হয়। ঈদের এই কয়ডা দিন কেমনে চলমু ভাই জানি না।”
আগে একটা ভাড়া বাসায় থাকলেও সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন বস্তিবাসী হয়েছে ওরা। ভাইবোন ও বাবা-মাসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারে গত বছর থেকে ‘ঈদ আসেনি’।
যাত্রাবাড়ি ও সায়েদাবাদ এলাকার বাস স্টেশনগুলোতে পান-সিগারেট বিক্রি করা ইলিয়াস বলেন, “ঈদ আমাদের জন্য বিলাসিতা। ওই সব আমাগো গরিবের ঘরে আহে না।
“খাওন নাই ভাই। খাওন লাগব। বাপের চিকিৎসা করামু, টাকা লাগব। মার পিন্দনের কাপড় নাই, কাপড় কিনমু। বইনডারে অন্তত ইশকুলে পাঠামু। তারে তো কিছু কিনা দিওন লাগে ভাই। তারে কিছু দিমু।”
ছোট এই বোনকে ঘিরেই এখন স্বপ্ন দেখে ইলিয়াস, নিজের জীবনের অপূর্ণতা তাকে দিয়ে পূরণ করতে চায় এই শিশু।
টিটিপাড়া এলাকার হকার রনির জীবনের গল্পটাও ইলিয়াসের মতোই।
ভোলা থেকে রাজধানীতে আসা ১৩ বছরের রনিকে পড়ালেখার পাট শিকেয় তুলে ছুটতে হয় জীবনের তাগিদে। ঢাকার তপ্ত রাজপথে ঝোলা কাঁধে সেও বেরিয়ে পড়ে। গৃহস্থালির নানা পণ্য ফেরি করে বাসে বাসে।
রনি বলেন, “কুনু দিন ভাবি নাই এই হকারি করুম। কি করুম, কপালের ফের। কিছু তো কইরা খাওন লাগব। বাড়িত মা-বইনেরা আছে। তাগো তো কিছু টাকা হইলেও পাঠান লাগে।”
রমনা পার্কে পাতা কুড়ায়, কাগজ কুড়ায় রিমি, সুরাইয়া, কামরুলদের দল। ওরা জানায়, কখনো কখনো পার্কে চকলেট ফেরি করে, কখনো ফুল।
“নতুন জামা কিনা দিতে পারে নাই। কাল সারা দিন বাপের মনডা বেজার আছিল। তয় খায়াদায়া সে আমারে আর মারে নিয়া ঘুরছে। আমি এতেই খুশি।”
সুরাইয়ার প্রতিবেশী রিমি (৬) ফুল বিক্রি করে প্রতিদিন ১০০ টাকার মতো আয় করে।
রিমির বাবা নেই, কয়েক বছর আগে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তার এক ভাই একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করে। মা রমনায় ঝরা ফুল কুড়ান। সেই ফুলের মালা গাঁথা হলে তা ফেরি করে বেড়ায় রিমি।
ঈদের সেমাই খেয়ে রোজকার মতোই ফুল বিক্রির জন্য ছুটতে হয়েছে জানিয়ে রিমি বলে, “ঈদের দিন মায়ে সেমাই রান্না করছিল। খাইছি। তারপর মায় কইছে পার্কে মেলা লোকজন ঘুরতে আসব। তাই আমি ঈদের দিন থিকা পার্কে ঘুরতাসি।
“সুন্দর সুন্দর আপু, ভাইয়ারা আসে। তারা মালা কিনে নেয়। পাঁচ টাকার মালা কিনে কেউ বাড়তি টাকাও দেয়। তখন মনডা কি যে ভালা লাগে!”
কারওয়ান বাজারে পাইকারি আড়তের মজে যাওয়া সবজি কুড়িয়ে নিয়ে সে বস্তি এলাকায় বিক্রি করে।
দুঃখ করে কামরান বলেন, “পেডে খিদার জ্বালা। বাপে কইছে, যা নিজের পথ দেখ। একদিন ট্রেনে উইঠ্যা আইস্যা পড়ছি। তারপর নানা লোকের লগে কথা কইলাম। পরিচিত এক ভাইয়ের লগে দেখা হইছিল একদিন। সে আমারে এই কাজে ঢুকায়া দিসে। তারপর এই চলতাসে।”
ঈদে বাড়ির জন্য ‘মন টানে না’ জানিয়ে ছেলেটি বলে, “মায় মইরা গেছে ম্যালাদিন আগে। মারে শেষ দেখা দেখতে পারি নাই। খবর পায়া যখন গেছি, তখন মারে কবর দিওন শেষ। মায় থাকলে হয়ত যাইতাম বাড়ি।
“আব্বায় আরেকটা বিয়া করছে হুনছি। সৎ মা কেমন জানি না। আমার দুইডা ভাই। তারা আব্বার লগে ক্ষেতে কাম করে, কখনো হাওরে মাছ ধরে। ওগো রোজগার ভালো বলে আব্বায় ওগোরে কিছু কয় না। ওরা আব্বারে ট্যাকা দেয়, তাই আব্বা চুপ হয়ে থাকে।”
মুক্তা বলে, “বাপে রোজ রোজ মায়েরে মারে। ট্যাকা চায়। মায় একদিন কইছে, মারে তোর স্কুলে যাওন লাগবো না, তুই কামে যা। হেরপর এক খালার লগে আমি এই কামে আইলাম। রোজগার মোটামুটি। আম্মারে ট্যাকা দেই। আব্বায় এখন আর মারে মারে না।
“ঈদের দিন মা আমারে একটা জামা আইন্যা দিছে।”
নাইট স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি তুরাগ পরিবহনের বাসে কন্ডাক্টরের কাজ নিয়েছে কিশোর করিম। ঈদের দিন ছিল তার ‘কঠিন ডিউটি’।
ঈদের রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপকালে করিম জানায়, রাত ১২টার দিকে তাদের বাসটি যাত্রাবাড়ি ফিরে আসবে। তারপর ঘরে ফিরে মায়ের রান্না খেয়ে সে মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়বে।