তারা বলছেন, শিশু বয়সে মা হারিয়ে অনেক সংগ্রাম করে বড় হওয়া সুমন ‘ভেঙে পড়ার’ মানুষ ছিলেন না। তার এমন কিছু হলে ঘনিষ্ঠজনদের কেউ না কেউ জানতেন।
একাত্তরের শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদ যুদ্ধাপরাধ মামলায় চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। পলাতক এই যুদ্ধাপরাধীরই মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। এর বাইরে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে লেখালেখিও করতেন তিনি।
সে কারণেই সুমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে থাকতে পারেন বলে সন্দেহ করছেন তার খালা শেলী শাহাবুদ্দিন।
প্রবাস থেকে এক ইমেইল বার্তায় তিনি বলেন, “শুনেছি জেহাদিরা শত্রুকে গলা কেটে জবাই করে। আর যাদের তারা মুরতাদ, কাফের মনে করে তাদের কুপিয়ে মারে।”
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় রেললাইনের পাশ থেকে সুমন জাহিদের (৫৭) খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ‘ট্রেনে কাটা পড়ে’ তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের।
তবে সুমনের মৃতদেহের বিবরণ শুনে আত্মহত্যা বলে মেনে নিতে পারছেন না চিকিৎসক শেলী শাহাবুদ্দিন।
তিনি বলেন, “আমি জানি ওভাবে আত্মহত্মা অসম্ভব। ট্রেনে কাটা পড়লে মানুষ ক্ষতবিক্ষত হবে। কাগজের তথ্য অনুযায়ী এক্ষেত্রে তা হয়নি।”
সুমন আত্মহত্যা করার মতো মানুষ নয় মন্তব্য করে তার খালা বলেন, “সুমনের মা সারা জীবন সব কিছুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সুমনকেও আমি সেভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। লড়াই আর কষ্ট করতে শিখিয়েছি। সেটাই সে করেছে সারা জীবন। ”
সুমনের মামাতো ভাই জাহিদ হোসেনও বলছেন, সুমন আত্মহত্যা করতে পারেন তা তাদের কখনও মনে হয়নি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে ওর জানাজার সময় প্রজন্ম-৭১ এর একজন সদস্য বলছিলেন, ‘সুমন কোনোভাবে আত্মহত্যা করতে পারে না। এমন কী ঘটনা ঘটল, যা তাকে সুইসাইড করতে বাধ্য করবে? কেউ তাকে হুমকি দেয়নি তো? কেউ তাকে বলেনি তো, তুমি সুইসাইড না করলে তোমার বাচ্চাকাচ্চাকে মেরে ফেলব?” এসবও কিন্তু একটা ব্যাপার হতে পারে।
“সুমন কেন সুইসাইড করবে? ও কখনও হুমকিতে ভয় পেত না। এমন কোন ভয়াবহতা তাকে এ কাজে বাধ্য করল?”
জাহিদ হোসেন জানান, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার পর সুমন পুলিশের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। দীর্ঘদিন পুলিশের পাহারা ছিল, কিন্তু সুমন তাতে ‘বিব্রত হতেন’। পরে এক পর্যায়ে তার বাসা থেকে পুলিশ পাহারা তুলে নেওয়া হয়।
সে সময় ফেইসবুকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখি ও প্রচারের কারণে সুমন জাহিদকে একটি পক্ষ হুমকি দিয়েছিল এবং বিষয়টি নিয়ে তিনি থানায় জিডিও করেছিলেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, “জিডির বিষয়টি সুমন অনেক পরে আমাদের বলেছিল। পুলিশি পাহারা উঠে গেল। সুমন দুই বছর আগে ভাড়া বাসা ছেড়ে নিজের ফ্ল্যাটে উঠল। এই খিলগাঁও এলাকাটি তার অনেক দিনের চেনা।”
সকালে হাঁটতে বেরোনোর সময় সুমনকে কেউ ডেকে নিয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি দারোয়ান, প্রতিবেশী অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারেনি।
“তবে এমনও হতে পারে, পথে যেতে যেতে সুমনের সাথে কেউ কথা বলেছিল। এ এলাকায় তো সুমন অনেক দিন ধরে থাকে।”
সুমনের পারিবারিক কোনো সমস্যা ছিল না বলে দাবি করেন জাহিদ।
“সুমনের দুই শ্যালক তার কাছাকাছি ফ্ল্যাটে থাকত। শ্বশুরবাড়ি ও আমাদের মামাতো খালাতো ভাই বোনদের সঙ্গে ছিল তার চমৎকার সম্পর্ক। তার কোনো পারিবারিক সমস্যা ছিল না। এমনকি সুমন শেষবারের মতো যখন বাসা থেকে বেরিয়ে যায়, সেদিন ছিল আর দশটা দিনের মতো স্বাভাবিক।”
বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মকর্তা হিসেবে পেশাজীবন শুরু করা সুমন জাহিদ বহুজাতিক কোম্পানির পর দুটি ব্যাংকেও চাকরি করেছিলেন। মাস তিনেক আগে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ফারমার্স ব্যাংকের চাকরি।
জাহিদ হোসেন বলেন, “আমরা তখন সুমনকে বলেছিলাম, চাকরিটা কেন ছাড়লে? সুমন বলল, সে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে জয়েন করবে। কিছু দিন সে লেখালেখি নিয়ে থাকতে চায়। আমরা বাধা দেইনি। আমরা নিজেরাও সুমনের লেখালেখি পছন্দ করতাম।”
সুমন জাহিদের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত চলছে বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা আমাদের তদন্তের পর্যায়ে আছে এখন পর্যন্ত। এখনই মন্তব্য করার সুযোগ নাই যে এটা হত্যা, না আত্মহত্যা, না কি অন্য কিছু।
“আমাদের যেসব ইউনিট আছে, তারা প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করছে মৃতদেহ থেকে। এছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা খতিয়ে দেখছে। চিকিৎসকের কাছ থেকে যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে, সব নিয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত বলতে পারব।”
শুক্রবার জুমার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জানাজা শেষে সুমন জাহিদকে আজিমপুর কবরস্থানে তার মা শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের কবরে দাফন করা হয়।
সেলিনা পারভীনকে ১৯৭১ সালে আল বদর বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তখন সুমনের বয়স ছিল ১০ বছর। পরে অন্য বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে রায়ের বাজারে সেলিনা পারভীনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল।