লংগদু হামলা: বিচার হয়নি, পুনর্বাসনও আটকে

রাঙামাটির লংগদুতে পাহাড়িদের বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগের এক বছর পার হলেও হয়নি বিচার; ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ‘অপ্রতুল’ সরকারি বরাদ্দ নিয়েও চলছে জটিলতা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2018, 04:49 PM
Updated : 6 June 2018, 04:53 PM

ওই ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা না গেলে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা আবারও ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন লংগদুর জনপ্রতিনিধিরা।

গত বছরের ১ জুন খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কের চার মাইল (কৃষি গবেষণা এলাকা সংলগ্ন) এলাকা থেকে যুবলীগের লংগদু সদর ইউনিয়ন শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়নের লাশ উদ্ধারের পর এলাকায় উত্তেজনা দেখা দেয়। 

পরদিন লংগদু উপজেলা সদরের তিন টিলা পাড়া, বাত্যাপাড়া,  উত্তর ও দক্ষিণ মানিকজুড় ও বড়াদম এলাকায় পাহাড়িদের ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তিনটি গ্রামের ২১৩টি পরিবার।

এই হামলার বছর পূর্তিতে বুধবার ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি আলোচনা সভা আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জনউদ্যোগ, আইইডি ও কাপেং ফাউন্ডেশন।

‘লংগদুর অগ্নিসংযোগ ও সাম্প্রদায়িক হামলার এক বছর : গৃহ নির্মাণসহ সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক এই সভায় ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের অভিযোগগুলো তুলে ধরেন।

ঘটনার পর দায়ের করা দুটি মামলায় ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও একজন ছাড়া বাকি সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সম্পাদক পল্লব চাকমা, যিনি অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।  

সংঘাতের দিনে বাড়িতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হলে তিনটিলা এলাকায় ঘরে বৃদ্ধা গুণমালা চাকমার মৃত্যুর খবর এসেছিল স্থানীয়দের কথায়।

তার মেয়ে কালা সোনা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিএনএ টেস্ট করানোর জন্য হাড়গোড় নিতে এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার দগ্ধ মায়ের হাড়গোড় দেখে সেগুলোকে ‘গবাদি পশুর হাড়ও হতে পারে’ বলে মন্তব্য করেছিল।

“আমার ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে, আমি বাস্তুহারা হয়েছি। কিন্তু আমি তো আমার মায়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার পাইনি।”

ডিএনএ পরীক্ষার নামে গড়িমসি হচ্ছে অভিযোগ জানিয়ে কালা সোনা বলেন, ”ঘটনার পর মামলা করতে গেলে তা না নিয়ে জিডি হিসেবে নথিভুক্ত করে। আমি আমার মায়ের হত্যার বিচার চাই।”

রাঙামাটির লংগদুতে হামলার প্রতিবাদে ঢাকায়ও কর্মসূচি পালন করেছিল পাহাড়িরা (ফাইল ফটো)

তার কথার সূত্র ধরে কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ সভায় বলেন, “বাংলাদেশে প্রবল শক্তিশালী সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে পড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও দুর্বল জাতিগোষ্ঠী এখন অত্যন্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন।”

১৯৮৯ সালে লংগদুতে হামলার আরেকটি চিত্র উপস্থাপন করে তিনি বলেন, “সেদিন ৩০ জন পাহাড়ি আদিবাসী হত্যাকারীদের বিচার হলে লংগদুর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত না।”

প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেন, “ব্রিটিশ আমল, পরে পাকিস্তান আমল থেকে পাহাড়ে চলছে সেনাশাসন। সেখানে ডিসি, এসপির কার্যত কোনো ভূমিকা নেই। পাহাড়ে এভাবে বিচারহীনতার রেশ চলতে পারে না।”

লংগদুর ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (সার্বিক) নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আলোচনা সভায় বক্তারা প্রশাসনিক এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

সভায় আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আইইডির নির্বাহী পরিচালক নোমান আহমেদ খান, লংগদু ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কুলীন মিত্র চাকমা, আচারকছড়ার চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমাও বক্তব্য রাখেন।  

পুনর্বাসনেও জটিলতা

লংগদুর ঘটনায় প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৫ লাখ টাকা সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। পরে নগদ টাকা দেওয়ার পরিবর্তে সরকারের আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় ২১২টি পরিবারকে তিন কক্ষবিশিষ্ট বসতবাড়ি ও আটটি দোকান নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।

গত এক বছরেও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, বরং লংগদুর ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বাড়িঘর নির্মাণ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা।

মূল প্রবন্ধে পল্লব বলেন, লংগদুর ঘটনায় ৩৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি পরিবারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া, দরপত্র নিয়ে জটিলতার অভিযোগ আনেন তিনি।

পল্লব বলেন,  “ভাড়াটিয়া দোহাই দিয়ে ৩৬টি পরিবারকে বাদ দিয়ে সরকার ৯ কোটি ২৪ লাখ টাকায় ১৭৬টি পরিবারের জন্য বাড়ি নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়।

“দুই বার দরপত্র ঘোষণা করলেও বাজারমূল্যের তুলনায় গৃহ নির্মাণের প্রাক্কলিত বাজেট কম হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাড়ি নির্মাণ কাজের জন্য দরপত্র দাখিল করেনি। পরে আবার ৭৫ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে তৃতীয়বারের মতো টেন্ডার দেওয়া হলে ঠিকাদাররা ৯.৫ শতাংশ বাড়তিতে দরপত্র দাখিল করেন।”

হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় গারো ছাত্র সংগঠনের মানববন্ধন (ফাইল ফটো)

পল্লব বলেন, “এই ৯.৫ শতাংশ বাড়তি নিয়ে আরেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। ৩০ মে কোনো ওয়ার্ক অর্ডার ছাড়াই আওয়ামী লীগের রাঙামাটি জেলার সভাপতি দীপংকর তালুকদার তিনটিলা গ্রামের একজন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ঘর নির্মাণ উদ্বোধন করেন।

“আদতে লংগদুতে কোনো বাড়িঘর নির্মাণ শুরু হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে কার্যাদেশও দেয়নি।”

পল্লবের কথার সূত্র ধরে ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেন, লংগদুতে ক্ষতিপূরণ নিয়ে ‘তামাশা চলছে’।

“সরকার যদি তাদের সর্বোত্তম ক্ষতিপূরণ দিতে চায়, তাহলে পাঁচ লাখ টাকার পরিবর্তে তাদের ১০ লাখ টাকা দিতে হবে।”

“সরকার সেনাবাহিনীর নকশা অনুযায়ী বাড়িঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ে কীভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে হবে, সেটা আদিবাসীরাই ভালো জানে। তাদের কথা শোনা হচ্ছে কি?” প্রশ্ন করেন এই রাজনীতিক।

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রাঙামাটি জেলা প্রশাসন থেকে এক বছরের জন্য যে রেশন বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা বাড়িয়ে তিন বছর করারও দাবি করেন  বক্তারা।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য পাহাড়ে সমস্যা সমাধানে পার্বত্য শান্তি চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নের তাগিদ দেন।

সরকার ও জনসংহতি সমিতির একযোগে কাজ করার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “তারা যদি একসাথে মাঠে নামেন,  তাহলে বেশি সময় লাগবে না। কারও ক্ষমতা নেই সেখানে পরিস্থিতি ঘোলা করে।”