ইভিএমে কেন্দ্র প্রতি ব্যয় সাড়ে ৩ লাখ টাকা

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পরিচালনায় গড়ে প্রতি কেন্দ্রে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করছে নির্বাচন কমিশন, যা ব্যালট পেপারের কেন্দ্রগুলোর ব্যয়ের ছয় গুণ।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2018, 06:12 PM
Updated : 5 June 2018, 06:12 PM

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহারে ব্যয় একটু বাড়বেই। কিন্তু এর টেকসই উত্তরণ ধরে রাখতে হবে। দুয়েকটি কেন্দ্র ছাড়িয়ে পুরো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে সুফল আসবে বেশি।

ইসি সচিবালয়ের নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, রংপুর সিটি করপোরেশনের ভোটে একটি কেন্দ্রের জন্য ৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং খুলনার দুটি কেন্দ্রের ভোট পরিচালনায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।

পরিচালনা খাতে ইভিএম সেটসহ আনুষঙ্গিক মালামাল পরিবহন, টিমের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানী ভাতা, গাড়ি ভাড়া, ডেকোরেটর সামগ্রী ভাড়া, স্ক্রিনসহ মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর-শব্দযন্ত্র ভাড়া, মাইকিং, প্রদর্শনীর জন্য কাস্টমাইজড মেশিন পরিবহন, অপ্রত্যাশিত ব্যয় ও ভোটের দিন কেন্দ্রে অবস্থারত কর্মকর্তাদের সম্মানীতে ব্যয় হয় এ অর্থ।

খুলনা সিটি করপোরেশন ইভিএমে ভোট দিচ্ছেন এক বৃদ্ধ ভোটার (ফাইল ছবি)

এ ব্যয়ে প্রতিটি ইভিএমের মূল্য বিবেচনায় আনা হয়নি। নতুন ইভিএম মেশিনের প্রতিটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে দুই লাখ টাকা।

খুলনা সিটি নির্বাচনে মোট বাজেট ছিল ৩ কোটি টাকার। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনায় ব্যয় ধরা হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। আইন-শৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বরাদ্দ করা হয় ২ কোটি ১০ লাখ টাকা।

সেক্ষেত্রে ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে পরিচালনা খাতে গড়ে ৫২ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। যে অঙ্ক ইভিএমের একটি কেন্দ্রের ব্যয়ের ছয় গুণ কম।

‘ব্যয় বাড়বে, কিন্তু টেকসই হতে হবে’

২০১০ সালে এ টি এম শামসুল হুদা নেতৃ কমিশন ইভিএম চালুর পর এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখেনি পরবর্তী কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন কমিশন। এখন কে এম নূরুল হুদা কমিশন এসে নতুন ইভিএম চালু করছে।

ইভিএমের শুরু থেকে সম্পৃক্ত থাকা ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইভিএম বেশ দামে কিনতে হলেও প্রচলিত কাগজপত্র খরচের সাশ্রয় হচ্ছে। আবার ইভিএম পরিচালনায়ও দরকার পড়ে ট্রেইনড লোকবলের; এ জন্যে তো খরচ হবেই। কিন্তু প্রযুক্তিটি যদি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই না হয়, তাতে তো লাভ আসবে না।”

ব্যালটে ভোটগ্রহণের পর এভাবে গণনায় সময় ও জনবল লাগে অনেক

তিনি জানান, প্রথমদিকে ইভিএম চালুতেও কেন্দ্রপ্রতি ব্যয় ছিল তুলনামূলক বেশি।

“যে কোনো কিছুকে উত্তরণ করতে হলে এর কস্টও রয়েছে; তবে এ প্রযুক্তিটি যদি একবার চালু হয়ে আরেকবার বন্ধ হয়; নতুন আরেকটি আসে, কিংবা আবার নতুন কমিশন এলে এটা বাদ দিয়ে আরেকটিতে যায় তাহলেও লাভ হবে না। এজন্যে প্রযুক্তিটিকে সাসটেইনেবল করতে পারলে এ ব্যয় কমে আসবে এবং প্রযুক্তিতে সহজ ব্যবহার ও সহজলভ্য করতে হবে,” বলেন জেসমিন টুলী।

ইভিএমের পক্ষে যুক্তি হল, এতে ভোটগ্রহণ ও গণনা বেশ সহজ এবং ফলাফলও দেওয়া যায় দ্রুত। পাশাপাশি এতে কাগজের সাশ্রয়ও ঘটে।

ইভিএমে ব্যয়ের খতিয়ান

গত ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে এবং ১৫ মে খুলনা সিটি ভোটে দুটি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হয়।

ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব মাহফুজা আক্তার কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৯ মে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুকূলে ছয় লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

নির্বাচন কমিশনের নতুন ইভিএম

এর আগে ৫ এপ্রিল ইভিএম সেটসহ আনুষঙ্গিক মালামাল পরিবহন খরচ বাবদ পাঁচ কর্মকর্তার অনুকূলে ৭৩ হাজার টাকা মঞ্জুর করা হয়।

গত ১৪ ডিসেম্বর রংপুর সিটি নির্বাচনে ইভিএমে ভোট পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বরাদ্দ দেওয়া হয় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৭০০ টাকা।

ইভিএম পরিচিতি ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যয় বাবদ গত ৪ জানুয়ারি অনুমোদন দেওয়া হয় আরও ৩৮ হাজার টাকা।

সব মিলিয়ে ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোট পরিচালনায় বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে ইসিকে।

৮ খাতে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যয়

>> অপারেটর ও স্ক্রিনসহ প্রজেক্টর ও শব্দযন্ত্র ভাড়া (৬ দিনে)- ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

>> টিমের কর্মকর্তা-কর্মচারি সম্মানী ভাতা- ২ লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ টাকা।

>> দুটি গাড়ি (৭দিন) ভাড়া-৫৬ হাজার টাকা্।

>> ডেকোরেটর সামগ্রী ভাড়া – ২১ হাজার টাকা।

>> মাইকিং (৩দিন)-১২ হাজার টাকা।

>> আনুষাঙ্গিক ব্যয়- ১৮ হাজার টাকা।

>> প্রদর্শনীর জন্যে পরিবহন (ঢাকা-খুলনা এ্যান্ড কাস্টমাইজ)-৭৪ হাজার টাকা।

>> ভোটের দিন ও পরের দিন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সম্মানী- ৬০ হাজার টাকা।

>> ৫ এপ্রিল ইভিএম সেটসহ আনুষঙ্গিক মালামাল পরিবহন বাবদ ব্যয় হয় ৭৩ হাজার টাকা।

খুলনার মতো রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে  আটটি খাতে ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৯৪ হাজার ৫০০ টাকা; ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা; ২৪ হাজার ৫০০ টাকা; ১৪ হাজার টাকা; ৯ হাজার টাকা; ২১ হাজার টাকা; ১৮ হাজার টাকা ও ৩৬ হাজার টাকা।

এছাড়া পরিচিতি ও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ব্যয় ৩৪ হাজার টাকা।

গাজীপুরে ৬ কেন্দ্রে ইভিএমের প্রস্তাব

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সম্ভব না হলেও স্থানীয় নির্বাচনে এ প্রযুক্তির ব্যবহার ধীরে ধীরে বাড়ছে। রংপুর ও খুলনার পর ২৬ জুন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর ছয়টি কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

সোমবার গাজীপুর সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার রকিবউদ্দিন মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ছয়টি কেন্দ্রে ইভিএম ও তিনটি কেন্দ্রে সিসিটিভি স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছি। কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেবে সেখানে আমরা ব্যবস্থা করব।”

ইভিএমের জন্য প্রস্তাবিত কেন্দ্রগুলো হচ্ছে ১৫৪, ১৫৫, ১৭৪, ১৭৫, ১৯১ ও ১৯২ নম্বর কেন্দ্র।

রংপুরে ইভিএমে ভোট দিচ্ছেন এক নারী ভোটার (ফাইল ছবি)

এদিকে ইসির নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইন্সটিউটে (ইটিআই) চলছে ইভিএম সংক্রান্ত ‘মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ’। মঙ্গলবার তৃতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণে অংশ নিতে কর্মকর্তাদের ডাকা হয়েছে।

মাঠ কর্মকর্তাদের জন্যও ইভিএম নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে ইসি। এর প্রথম ধাপে ৬ জুন বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলের সব কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে বরিশালে এক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ৬-৭ জুনের দুই দিনব্যাপী এ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।

এতে ইভিএম নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনা, টেকনিক্যাল উপস্থাপনা, গণমাধ্যম ও জনপ্রতিনিধিদের ইভিএমে ভোট প্রদান পদ্ধতি প্রদর্শন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং দুটি স্পটে প্রদর্শনীর মাধ্যমে জনসচেতনার কর্মসূচি রয়েছে।

এনআইডি মহাপরিচালক ছাড়াও অন্তত ১৮ জনের সমন্বয় টিম, প্রশিক্ষক টিম ও ডেমোনেস্ট্রেশন টিম থাকবে এ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে।