চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনাগুলো নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এই বক্তব্য ঢাকার রিকশাচালক রাশেদ খানের।
তার মতো অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য নিয়ে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাদক নির্মূলে র্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী অভিযানে নামার পর প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন সন্দেহভাজনরা। গত ১১ দিনের মৃত্যুর সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে।
প্রথমে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের কথা বলা হলেও এখন গুলিবিদ্ধ লাশের খবর দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি করে মারা পড়ছেন তারা।
নিহতদের বিভিন্ন স্বজনরা অভিযোগ তোলার পর মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ মৃত্যুগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, এই অভিযানের লক্ষ্য হতে পারে তার দলের নেতা-কর্মীরা।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সমালোচকদের সমালোচনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষেই অবস্থান প্রকাশ করেছেন।
এই প্রেক্ষাপটে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রায় সবাই বলেন, এই অভিযানে তাদের সমর্থন রয়েছে, তবে প্রশ্ন রয়েছে মৃত্যুর ঘটনাগুলো নিয়ে।
চট্টগ্রামে নিহত হাবিবুর রহমানকে ভুল তথ্যে ‘মারা হয়েছে’ বলে অভিযোগ তার স্বজনদের
নীলফামারী থেকে ঢাকায় এসে রিকশা চালানো রাশেদ খান বলেন, “মনে করেন আমি এখন অপরাধী, অপরাধের জন্য তো আমার জাগা আছে, আইন আছে। আইন যদি না থাকত, যে অপরাধ করছে, তার বেলা অন্য কিছু হতে পারত। আইনের মাধ্যমে শাস্তি হবে, তখন সবাই দেখবে।”
রামপুরা এলাকার ‘কুমিল্লা স্টোর’ নামে একটি দোকানের বিক্রয়কর্মী রুবেল হাসান বলেন, “অভিযানে ঠিক কাজই করতেছে। তবে বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীকেও শাস্তি দেওয়া উচিত। কিন্তু এভাবে না, আইনের মাধ্যমে তাদের ফাঁসি দিতে হবে।”
অটোরিকশা চালক আসাদুর রহমান বলেন, “আগে মাদকের হোতাদের ধরতে হবে। তারপর ছোট ছোট কারবারিদের ধরে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। বন্দুকযুদ্ধে তো সবাইকে শেষ করে দেওয়া সম্ভব না। আইনকে কঠিন করে বড় বড় হোতাদের ফাঁসি দিতে হবে।”
উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চাকরির সন্ধানে থাকা আহসানুল হক বলেন, “অভিযানকে স্বাগত জানাই। কারণ আমাদের দেশের প্রতিটি জায়গাতে মাদক ঢুকে গেছে, এর ফলে যুবসমাজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।”
স্কুল শিক্ষক ছালাতুর রহমান সবুজ বলেন, “যদি সত্যিকারের মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়, তা ভবিষ্যতের জন্য ভালো। কিন্তু রাঘব বোয়ালদের ধরতে এখনও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। মাদক চালানের রুট হল সীমান্ত এলাকা, কিন্তু সীমান্তে কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে ধরার মতো কোনো লক্ষণ এখনও দৃশ্যমান নয়।”
পত্রিকার হকার মোহাম্মদ হিরণ অভিযানে সমর্থন জানালেও সমর্থন জানাতে পারছেন না ‘ক্রসফায়ারে’।
তিনি বলেন, “একটি মানুষকে হঠাৎ করে ধইরা... সে মূল অপরাধী কি না.. আবার সেটাও বলা যায়, তারা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) তো জাইন্যা-শুইন্যাই ধরে। তবে একটু বিচারের আওতায় এসে কাজটা করলে মনে হয় ভালো হয়।”
কক্সবাজারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর একরামুল হকের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রাজিয়া সুলতানা বলেন, “এতগুলো মানুষ ক্রসফায়ারে মারা গেল! আমরা কিন্তু জানি না, তারা কোন পর্যায়ের মাদক ব্যবসায়ী, কিংবা আদৌ ব্যাবসায়ী কি না?
“এভাবে তো এই সমস্যার সমাধান হবে না। দেশে আইন-আদালত রয়েছে।”
চট্টগ্রামের সমাজকর্মী শরীফ চৌহান বলেন, “মাদকবিরোধী উদ্যোগকে আমি সমর্থন করি, তবে এমন বন্দুকযুদ্ধকে সমর্থন করি না। যেভাবে চলছে তথ্যের বিভ্রাটের কারণে কোনো নিরীহ মানুষ মারা যাক, সেটা কাম্য নয়।”
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ বলেন, “পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়- এ নীতি কথাকেই আমরা সত্য বলে জ্ঞান করেছি। বর্তমান যে পথ অবলম্বন করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে পাপ এবং পাপী উভয়কেই ধ্বংস করতে হবে।”
যারা মারা যাচ্ছে, তাদের প্রতিও রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা পদ্ধতি হচ্ছে মানবতার চরম পরিপন্থি। একটি স্বাধীন দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য যতগুলো অনুষঙ্গ প্রয়োজন হয়, তার সবটাই আমাদের দেশে আছে। তারপরও কেন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে এ হত্যাপদ্ধতি?”
ডয়েচে ভেলের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রাহাত রাফি বলেন, যে লক্ষ্যে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
“বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা যদি ঘটতে থাকে মাদকবিরোধী অভিযান মানববিরোধী অভিযানের তকমা পেয়ে যেতে পারে। তাতে খুব দ্রুতই এ অভিযান সামাজিক বৈধতা হারাবে।”
কুষ্টিয়ায় অভিযান শেষে ফিরছে পুলিশ, সোমবার রাতে এই জেলায় নিহত হন দুজন
মাদক নির্মূল করতে চাইলে আইনের কার্যকর প্রয়োগ ঘটিয়ে শাস্তি নিশ্চিতের উপর জোর দেন অধিকাংশ ব্যক্তি।
শরীফ চৌহান বলেন, “যারা মূল হোতা, বর্ডারে থেকে যারা এসব নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। একই সাথে প্রশাসনের যারা মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
ব্যাংক কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান মনে করেন, মাদক সমস্যা সমাধানে সীমান্তে পাহারাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, “উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশে ইয়াবা ঢুকছে মূলত একটা এলাকা দিয়ে, তারপর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের সমুদ্রসীমায় নজরদারি বাড়াতে হবে, কোস্টগার্ডকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। রুট যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দেশব্যাপী এই অভিযানে খুব একটা লাভ হবে না।”
চলচ্চিত্র নির্মাতা মাহমুদ দিদার মাদক চক্রের সঙ্গে প্রশাসনের যোগসূত্র ছিন্ন করার উপর জোর দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, “মাদক ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের ব্যবসার খাতিরে প্রশাসন কিংবা স্থানীয় ক্ষমতাধরদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। বাংলাদেশেও তা ই হয়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরেই এটা চলে আসছে।
“প্রশাসনের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সংযোগ ছিন্ন করতে হবে। ক্রসফায়ারে সাময়িক সমাধান এলেও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান এতে হবে না।”
মাগুরায় গুলিবিদ্ধ তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয় মঙ্গলবার রাতে, যারা মাদক কারবারি বলে পুলিশের দাবি
আইনের প্রয়োগের কথা বলা হলেও তাতে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ রয়েছে। তা উঠে এসেছে আইনজীবী আসিফ আল আমিনের কথায়ও।
তিনি বলেন, “বিগত কয়েক বছরে অন্তত কয়েক লাখ ইয়াবা ব্যবসায়ী ধরা পড়েছে, মামলা হয়েছে এবং চার, পাঁচ কিংবা ছয় মাসের মাথায় জামিন নিয়ে তাদের বেশিরভাগই আবার ইয়াবা ব্যবসায় ফিরে গেছে। মামলা চলতে থাকে, আসামি উপস্থিত থাকে না, সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় হয় না এবং একসময় মামলা মরে যায়।”
তাহলে সমাধান কী- প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, “মাদক সংক্রান্ত মামলাগুলোর জন্য যদি বিশেষ আদালত করা যেত কিংবা অন্তত দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এই মামলাগুলোকে নিয়ে আসা যেত, তাহলে একটা স্থায়ী সমাধানের দিকে যাওয়া যেত।”
তবে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয় বলে মনে করেন আল আমিন।
“কোনো কিছু যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন তাৎক্ষণিক স্টেপ নিতে হয়। আইনের দৃষ্টিতে ক্রসফায়ার কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়; কিন্তু বর্তমানে সমাজের যে পরিস্থিতি তাতে কিছু জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য এটা একটা নিকৃষ্ট সমাধান হিসেবে উপস্থিত হয়েছে।”