ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণ জানা, সমাধান হচ্ছে না

সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবার ঢাকায় জলাবদ্ধতা ‘সহনীয়’ থাকবে বলে আশার কথা শোনালেও নাগরিকদের অভিজ্ঞতা কিন্তু আগের মতোই, অর্থাৎ সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় পানি জমে ভোগান্তি।

ওবায়দুর মাসুম নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2018, 04:39 AM
Updated : 27 May 2018, 04:51 AM

রাজধানীর জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে বিভিন্ন এলাকায় নালা ও খালগুলো দিয়ে পানি সরতে না পারাকে চিহ্নিত করা হলেও এর সুরাহা হচ্ছে না। এজন্য পরস্পরকে দোষারোপ করছে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা।

এই প্রেক্ষাপটে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলছেন, একে অন্যকে দোষারোপ করে কোনো কাজ হবে না। খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।

“এই কাজ চালাতেই গিয়ে যেখানে যেখানে অবৈধ দখল আছে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে।”

গত বর্ষায় ঢাকায় জলাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনার মুখে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আগামী বছর ঢাকায় জলাবদ্ধতা তেমন হবে না।

গত ৯ এপ্রিল সিটি করপোরেশনের এক সভায় ওয়াসার পক্ষ থেকেও একই ধরনের আশাবাদ জানানো হয়।

তবে এই আশ্বাসের প্রতিফলন বাস্তবে খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। বর্ষার আগেই বৈশাখের কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতে ডুবছে বিভিন্ন এলাকা।

মিরপুরের মেহেদীবাগ এলাকায় সাংবাদিক খাল হয়ে পড়েছে সরু

যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা

গত বর্ষায় বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে জলাবদ্ধ এলাকা ও এর কারণ চিহ্নিত করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রকৌশল বিভাগ। সমস্যা সমাধানে কিছু সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন গত বছর ১৬ জুলাই ডিএনসিসির সমন্বয় সভায় তোলা হয়।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলাবদ্ধতা হয় এমন এলাকাগুলো হল- প্রগতি সরণির কোকাকোলা থেকে বসুন্ধরা, বাড্ডার প্রধান সড়ক ও অলিগলি, খিলগাঁওয়ের ওয়াসা রোড, পূর্ব হাজীপাড়া, মৌলভীরটেক, খিলগাঁও বি-ব্লক ও তালতলা এলাকা, নাখালপাড়ার বিভিন্ন সড়ক, মগবাজার এলাকার লেন-বাইলেন, মিরপুরের কালশী রোড, মেহেদীবাগ, মিরপুর বিআরটিএর সামনের সড়ক, রাইনখোলা, বাউনিয়া এলাকা, পল্লবী, বেগম রোকেয়া সরণি, বনানী রেলস্টেশন থেকে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত সড়ক।

এছাড়া রয়েছে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের এক, দুই, তিন নম্বর সড়ক এবং শায়েস্তা খাঁ এভিনিউ, খিলক্ষেতের নামাপাড়া, মধ্যপাড়া এবং লেকসিটি কনকর্ড আবাসিক এলাকা, নিকুঞ্জ ও খিলক্ষেত টানপাড়া এলাকা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সিটি করপোরেশন এলাকার মতিঝিল, কমলাপুর, আরামবাগ, বঙ্গভবন, গুলিস্তান, বকশীবাজার, ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর, শুক্রাবাদ, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ ও মগবাজার এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়।

আবর্জনায় পূর্ণ ইব্রাহিমপুর খাল

যে কারণে জলাবদ্ধতা

ডিএনসিসি বলছে, অপ্রশস্ত ও নিচু কালভার্ট, অবৈধ দখল, কঠিন বর্জ্যে খাল ভরাট হয়ে যাওয়া, খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করা, খালের নির্গমন পথ সরু থাকায় পানি নিষ্কাশনে দেরি হয়ে আশপাশের এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

এছাড়া ওয়াসার খালগুলো ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাওয়া, খালের নাব্য হ্রাস পাওয়া, পানি নিষ্কাশনে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকা, কালভার্টগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার না করায় পানি সরতে পারছে না। প্রয়োজনীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা, ওয়াসার ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি।

জলাবদ্ধতা নিয়ে ডিএনসিসির প্রতিবেদনে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সুপারিশ করা হয়েছিল। এতে বলা হয়, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, বর্ষা মৌসুমের আগেই খাল পরিষ্কার, খালে পানি প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, খালের ওপর নির্মিত রাস্তা কেটে খাল পুনরুজ্জীবিত করা। দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ হিসেবে সবগুলো খালের প্রকৃত সীমানা চিহ্নিত করা এবং মূল প্রশস্ততায় খাল খনন এবং খালের পাড় সংরক্ষণের কথা বলা হয়।

বাউনিয়া খালের ওপর গড়ে তোলা ভবনের ভিত্তি, পাশে রূপসী আবাসিক এলাকা থেকেও ভরাট হচ্ছে খাল

বাস্তব অবস্থা

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে গত এক একবছরে আড়াইশ কিলোমিটার নালা তৈরির কথা জানিয়েছে ডিএনসিসি। আর বিশেষ কার্যক্রম হিসেবে শান্তিনগর এলাকায় ১১ দশমিক ৭২ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করেছে ডিএসসিসি। এছাড়া নাজিমুদ্দিন রোডসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে।

তবে এসব ড্রেনের পানি যে খালে গিয়ে পড়ে, সেসব খাল উদ্ধার বা পরিষ্কারের কাজ এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। রাজধানীর বেশিরভাগ খালে এখনও ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ। খালের ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ দখলদার উচ্ছেদেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কয়েকটি খাল ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।

মিরপুর ১৪ নম্বরের ডেন্টাল হাসপাতালের পেছনে বাউনিয়া খাল প্রায় পুরোটাই ভরে গেছে। প্রতিবন্ধী কল্যাণ ফাউন্ডেশন এবং সিআরপির পেছনের অংশে খালের বস্তিও উচ্ছেদ করা হয়নি। সেখানেও খালে ময়লা-আবর্জনা জমে আছে। ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প এবং রূপসী আবাসনের মাঝখানে খালের ওপর করা হয়েছে বিভিন্ন ভবনের ভিত্তি। রূপসী আবাসন এলাকা থেকে কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে খালে।

পলাশনগর এবং বাইশটেকি এলাকায় সাংবাদিক খালের দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি। স্টিলব্রিজ থেকে বাউনিয়া খালের সংযোগ পর্যন্ত আবর্জনা জমে আছে।

পলাশনগরের বাসিন্দা আবদুল হাকিম জানান, কালভার্টের কাছে খাল মোটামুটি প্রশস্ত। কিন্তু পরের বাড়িগুলি দুইপাশ থেকে খাল দখল করছে। বৃষ্টি হলে খালের পানি এখানে আটকে যায়। দুপাশের বাড়িঘরে পানি উঠে যায়।

কাগজে কলমে ২০ ফুটের সাংবাদিক খাল পল্লবীর সবুজ বাংলা আবাসিক এলাকায় এসে হয়ে গেছে চার ফুট। ফলে পানি সরতে পারে না। দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা রয়ে গেছে। দেখা গেছে, মাস তিনেক আগে একপাশের বাড়িঘর ভাঙলেও আবার গড়ে উঠেছে।

ডিএনসিসির ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নান্নু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা নিজেদের উদ্যোগে খাল পরিষ্কার করেছেন। কিন্তু দখল এখনও উচ্ছেদ হয়নি।

এই হল প্যারিস খালের অবস্থা

প্যারিস খালের প্রবাহ বইছে কোনোভাবে। সেখানেও বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এসব স্থাপনাও উচ্ছেদ করা হয়নি। মিরপুরের মেহেদীবাগ এলাকায় খালে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকলেও তা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

একই অবস্থা কল্যাণপুর ‘খ’ খালের। খাল সংস্কারে ওয়াসাকে কয়েকদফা চিঠি দিয়েও কোনো কাজ হয়নি বলে অভিযোগ করেন ডিএনসিসির ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন তিতু।

“ওই খালের অবস্থা ভালো না। খাল সংস্কারের জন্য আমরা কয়েকবার ডিও দিয়েছি। কিন্তু ওয়াসা তো কোনো কাজই করে না।

ইব্রাহিমপুর খাল এখনও ময়লা-আবর্জনায় পূর্ণ। ইব্রাহিমপুর ১০ নম্বর পানির পাম্পের কাছে বক্স কালভার্টের গোড়ায় খাল আছে ৭ ফুটের মতো। খালে মাটি ভরাট করে দোকান বানানো হয়েছে। খালের ওপর গড়ে তোলা স্থাপনাও অক্ষত।

কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার খালও ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শরীফ উদ্দিন জানিয়েছেন, নিজস্ব এবং এডিপির অর্থায়নে জলাবদ্ধতা নিরসনে গতবছর কাজ শুরু করেছেন তারা।

“গত বছর যে সমস্যা ছিল আমরা এগুলো মোটামুটি ৬০ থেকে ৭০ ভাগই সমাধান করেছি। পাঁচটা অঞ্চলেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নালার কাজ করছি। খিলক্ষেত প্রধান সড়কে নিষ্কাশন নালা বানানো হয়েছে। হাতিরঝিলে একটি সংযোগ নালা করে দেওয়া হয়েছে। মিরপুরের বিভিন্ন সড়কে নিষ্কাশন নালা বসানোর কাজ এখনও চলছে। প্রগতি সরণীর বসুন্ধরা থেকে রামপুরা আবুল হোটেল পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার কাজ চলছে।”

বাইশটেকি ও পলাশনগরের মাঝখানে বাইশটেকি খাল। স্টিল সেতুর আগে খাল মোটামুটি প্রশস্ত। কিন্তু সেতুর পর দুপাশ থেকে দখল করা হয়েছে খাল

তবে খালগুলোর পানি প্রবাহ কম থাকায় জলাবদ্ধতা পুরোপুরি দূর হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

“জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে আমার খাল লাগবে। খালে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ড্রেনের প্রবাহ খালে গিয়েই মিলে। কিন্তু খালগুলোর অবস্থা তো ভালো না। অবশ্য ঢাকা ওয়াসাও চেষ্টা করছে।”

নিজেদের নিষ্কাশন নালা ঠিক থাকলেও ওয়াসার খালগুলো পরিষ্কার না থাকায় জলাবদ্ধতা পুরোপুরি দূর হচ্ছে বলে জানান ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, “ড্রেনগুলোও পরিষ্কার করা হয়নি। ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই পানি আর যেতে পারে না। কারণ পাম্পের ধারণ ক্ষমতা কম। পাম্পের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হবে, ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে হবে।

“আমাদের ড্রেনগুলো আমরা পরিষ্কার করছি। আমরা যত কিছুই করি না কেন, পানি তো ওয়াসার খালেই যায়। সেখান থেকে তারাই পানিটা বাইরে ফেলে। কিন্তু আমাদের তুলনায় ওয়াসা তাদের লাইনগুলো পরিষ্কার করছে না।”

একে অপরকে দোষারোপ করে কোনো কাজ হবে না বলে মন্তব্য করে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, “কে কী করলে কী হবে, কী হবে না এগুলো হলো একটা অবান্তর কথা। মূল কথা হলো আপনার কাজটা আপনি করছেন কি করছেন না। আমার কথা হলো হ্যাঁ, আমাদের কাজ আমরা করছি। কারটা করলে কী হয়, আমি তো কাউকে বলব না। আমার যেটা করার, আমি সেটা করব।”

খাল পরিষ্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তাকসিম এ খান।

তিনি বলেন, দখল উচ্ছেদেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

“আমরা ইতোমধ্যেই ঢাকার খালগুলো পরিষ্কারের কাজ শুরু করেছি। এই কাজ চালাতেই গিয়েই যেখানে যেখানে অবৈধ দখল আছে সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে। এছাড়া সামনে কিছু প্রকল্প আসছে সেগুলোতেও আমরা খালের পাড় বাঁধিয়ে দেব। তখন খালের সীমানা ধরেই তা করতে হবে। কোথাও দেখা গেল যে অবৈধ দখল আছে, তা উচ্ছেদ করে সেখানেই পাড় বাঁধাই করতে হবে।”