ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মঙ্গলবার খসড়া আইনটির বিষয়ে সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন-অ্যাটকোর সঙ্গে এই বৈঠক করে।
বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “এ আইনের বিষয়ে তিনটি সংগঠন তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা সেগুলো ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করব।”
“আইনটি মূলত যা আছে তাই-ই থাকবে, সেখানে ভাষাগত পরিবর্তন আসবে। যেসব বিষয় স্পষ্ট নয় সেগুলো স্পষ্ট করা হবে।”
তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি দাবি করে সেটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীরা। এই প্রেক্ষাপটে সরকার সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা তথ্য প্রযুক্তি আইন থেকে সরিয়ে সেগুলো আরও বিশদ আকারে যুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রস্তাব সংসদে তুলেছে।
গত ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার গত ৯ এপ্রিল ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ অনুমোদনের জন্য সংসদে উত্থাপন করেন।
পরে নিয়ম অনুযায়ী সেটি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয় পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য।
এ আইন পাস হলে হ্যাকিং; ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’; রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে বা ভয়ভীতি সৃষ্টির জন্য কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং ডিজিটাল উপায়ে গুপ্তচরবৃত্তির মত অপরাধে ১৪ বছরের কারাদাণ্ডের পাশাপাশি কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।
আর ইন্টারনেটে কোনো প্রচার বা প্রকাশের মাধ্যমে ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত’ করার শাস্তি হবে ১০ বছরের জেল, ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে অভিযোগ করেছে, সরকার নতুন আইন করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে নতুন নাম দিয়ে পুরনো সেই ৫৭ ধারাকেই রাখা হচ্ছে।
সংবাদকর্মীরাও প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারায় সমালোচনা করছেন। এ আইনের ফলে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ওই ধারা অনুযায়ী, সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
বৈঠকে সম্পাদক পরিষদ খসড়া আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮,২৯,৩১, ৩২, ৪৩ ধারার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি জানায়।
পরে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা ব্যক্তি বিশেষ নয়, সমস্ত দেশের জন্যই এ আইন করতে চাই। সাংবাদিকতা ব্যহত বা সাংবাদিকদের টার্গেট করে কোনো আইন আমরা করছি না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিপরীতে কোনো আইন আমরা সাংবিধানিকভাবে করতে পারি না।”
তিনি বলেন, যে আটটি ধারা নিয়ে আলোচনা হয়েছে সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংজ্ঞা স্পষ্ট নয়; সেগুলো স্পষ্ট করতে বলা হয়েছে।
“আটটি ধারায় যে অসুবিধার কথা গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সেগুলোর ব্যাখ্যা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমরা বক্তব্য দিয়েছি। আমি স্পষ্ট করে বলেছি- এগুলোর ক্ষেত্রে আমরা স্পষ্টীকরণের সুপারিশ করব।”
মন্ত্রী বলেন, “যেসব সংযোজন-বিয়োজন দরকার, তা করে আমরা সুপারিশ করব। তারপর সংসদীয় কমিটি যখন এ আইনের সংশোধন করে চূড়ান্ত রূপ দেবে, তখন আমরা এটি সংসদে পাস করার জন্য পাঠানোর আগে আবার গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসব, যাতে নতুন করে এটি নিয়ে সমালোচনা না হয়।”
তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা বাতিল প্রশ্নে তিনি বলেন, “আপনাদের সাংবাদিক প্রতিনিধিরা বলেছেন, পুলিশের সেলের অনুমতি ছাড়া ৫৭ ধারায় মামলা করা যাবে না বলে প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তারপর থেকে ৫৭ ধারার মামলা ৯৫ ভাগ হ্রাস হয়েছে। এ আইনটি হলে নিশ্চয়ই ৫৭ ধারা বাতিল হবে।”
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, “অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকতার অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে সেসব ধারায় বাধা আসতে পারে সেগুলো আমরা তুলে দিতে বলেছি।”
অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স- অ্যাটকোর প্রেসিডেন্ট ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান বলেন, “আমরা আইনের যে বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তিত, সেগুলো কমিটিকে জানিয়েছি। কমিটি আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছে তারা আমাদের উত্থাপিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবেন। তারা বর্তমানে আইনটি যেভাবে রয়েছে তা সংশোধন করে সংসদে তুলবেন।”
সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আটটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানানোর পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা থাকার কথা তারা সংসদীয় কমিটিকে বলেছেন।
“তারা আমাদের এই দাবির সাথে একমত হয়েছেন। যেসব ধারাতে বিন্দুমাত্র স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিরোধক ও স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধা রয়েছে- তার সমস্ত ধারাগুলি আমরা তুলে ধরেছি। আমি মনে করি, ওই আইনে যেসব ধারা নিয়ে আমরা খুবই দুঃচিন্তাগ্রস্ত ছিলাম, এই বৈঠকের মাধ্যমে সেগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরেছি। কমিটিও এ বিষয়গুলো সহানুভুতিশীল ও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছে। আমরা আশা করি আইনের কয়েকটি বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আসবে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, এটাকে একটি চূড়ান্ত রূপ যাওয়ার পরে আমাদের সঙ্গে আবারো বসবেন।”
মাহফুজ আনাম বলেন, পুরো আইনটি সাংবাদিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্য সব চেষ্টা করা হবে বলে সংসদীয় কমিটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
“স্বাধীন সাংবাদিকতার সাংবিধানিক যে অধিকার রয়েছে তার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে কমিটি বার বার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।”
বিএফইউজে সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, তারা বৈঠকের বিষয়ে ‘খুবই সন্তুষ্ট’। কমিটি আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
“আমরা এ আইনটি গণমাধ্যমে প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছি।”
সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, “খসড়া আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হয়েছে। স্টেকহোল্ডাররা এ জায়গাটা স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছে। এখানে সংবিধানের প্রস্তাবনায় যেভাবে চেতনার কথা বলা হয়েছে সেটি আনা হবে।”
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুভূতির আঘাতের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় যা আছে- সেটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
আর গুপ্তচরবৃত্তির সংজ্ঞায় ১৯২৩ সালের ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস’ আইনে যে সংজ্ঞা আছে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যোগ করা হবে বলে জানান তিনি।
ইমরান আহমদের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, শওকত হাচানুর রহমান (রিমন), কাজী ফিরোজ রশীদ, হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া এবং বিশেষ আমন্ত্রণে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বৈঠকে অংশ নেন।
এছাড়া অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল হক বাবু, বিএফইউজে মহাসচিব ওমর ফারুক বিশেষ আমন্ত্রণে যোগ দেন এই বৈঠকে।