রাজীবের ভাইদের ক্ষতিপূরণ: আপিলের আদেশ মঙ্গলবার

কলেজছাত্র রাজীবের দুই ভাইকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের করা আবেদনের বিষয়ে মঙ্গলবার আদেশ দেবে সর্বোচ্চ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 May 2018, 05:53 AM
Updated : 22 May 2018, 05:20 AM

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ সোমবার আবেদন দুটি শুনে আদেশের জন্য এই দিন ঠিক করে দেয়।

বিআরটিসির পক্ষে আপিল বিভাগে শুনানি করেন এ বি এম বায়েজিদ, তার সঙ্গে ছিলেন মুনীরুজ্জামান। স্বজন পরিবহনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আবদুল মতিন খসরু ও পঙ্কজ কুমার কুণ্ডু।

ক্ষতিপূরণের জন্য রিট আবেদনকারী আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজলও নিজেই আপিল বিভাগে শুনানি করেন।

শুনানিতে বিআরটিসির আইনজীবী এ বি এম বায়েজিদ বলেন, “আমরা তো ওই দিন কোনো অপরাধ করিনি। বিআরটিসির বাসটি দাঁড়ানো ছিল। স্বজন পরিবহন বাঁ দিক থেকে এসে ধাক্কা দিয়েছে।”
 
স্বজন পরিবহনের আইনজীবী আব্দুল মতিন খসরু এ সময় বলেন, “ঘটনাটা হৃদয় বিদারক। কিন্তু আমরা আপাতত পাঁচ লাখ টাকা জমা দিতে চাই।”
 
ক্ষতিপূরণের পক্ষে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, “হাই কোর্ট বিভাগ রুলে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের কথা বলেছে। টাকা জমা রাখার জন্য এরই মধ্যে একটা যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।”
 
শুনানি শেষে বিআরটিসির আইনজীবী মুনীরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘কারও ওপর অবিচার হোক, আমরা চাই না। হাই কোর্টের আদেশটা সংশোধন করতে হবে। আর ক্ষতিপূরণের টাকা যে রাজীবের দুই ভাই পাবে সেটা নিশ্চিত করাটা খুব কঠিন।’ আগামীকাল আদালত আদেশ দেবে।”

গত ৮ মে হাই কোর্ট রাজীবের দুই ভাইকে ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়ার পর ১০ মে সে আদেশ স্থগিত চেয়ে চেম্বার আদালতে আবেদন করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ও স্বজন পরিবহন।

চেম্বার বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দিলে সোমবার এ বিষয়ে শুনানি হয়।

গত ৩ এপ্রিল কারওয়ান বাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের রেষারেষিতে বিআরটিসির যাত্রী রাজীবের ডান কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার মাথার সামনে-পেছনের হাড় ভেঙে যাওয়া ছাড়াও মস্তিষ্কের সামনের দিকে আঘাত লাগে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৭ এপ্রিল রাতে সরকারি তিতুমীর কলেজের এই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। ওই দুর্ঘটনা এবং রাজীবের মৃত্যু পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

দুই বাসের চাপায় ঝুলতে থাকা রাজীবের হাতের ছবি সংবাদমাধ্যমে এলে ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে ৪ এপ্রিল হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।

এ বিষয়ে শুনানি করে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাই কোর্ট বেঞ্চ রাজীবের চিকিৎসা ব্যয় বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনকে বহন করতে নির্দেশ দেয়।

পাশাপাশি যাত্রীদের চলাচলে বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে কার্যকরের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনে আইন সংশোধন ও নতুন করে বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল দেয় আদালত।

ওই রুল শুনানির আগেই রাজীবের মৃত্যু হলে রুহুল কুদ্দুস কাজল ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আদালতে একটি সম্পূরক আবেদন করেন। এরপর হাই কোর্ট গত ৮ মে রাজীবের দুই ভাইকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়।

ওই এক কোটি টাকার অর্ধেক, অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য দুই পরিবহনের মালিককে এক মাসের সময় বেঁধে দিয়েছে হাই কোর্ট।

রিটকারীপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল সেদিন জানান, রাজীবের খালা জাহানারা পারভীন এবং রাজীবের গ্রামের বাড়ি বাউফলের সাবেক চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদের ছেলে কাস্টমস কর্মকর্তা ওমর ফারুকের নামে মতিঝিলে সোনালী ব্যাংকের প্রধান শাখায় একটি যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলা হবে।

বিআরটিসি এবং স্বজন পরিবহনের মালিককে এক মাসের মধ্যে ২৫ লাখ টাকা করে মোট ৫০ লাখ টাকা জমা দিতে হবে ওই অ্যাকাউন্টে। আর টাকা জমা দেওয়ার বিষয়টি ২৫ জুনের মধ্যে আদালতকে লিখিতভাবে জানাতে হবে।

২৫ জুন বিষয়টি আবার আদালতে এলে তখন বাকি ৫০ লাখ টাকার বিষয়ে আদালত নির্দেশনা দিতে পারে বলে সেদিন জানান রুহুল কুদ্দুস কাজল।

হাই কোর্ট ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়ার পর আদালতের বাইরে সেদিন সাংবাদিকদের সামনে তা নিয়ে আপত্তি জানান বিআরটিসির আইনজীবী মুনিরুজ্জামান।

তিনি বলেন, “কোনো ধরনের মূল্যায়ন না করেই যেন ক্ষতিপূরণের আদেশটি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় বিআরটিসি বাসের অবহেলাজনিত কোনো দায় ছিল কিনা- সেটা মূল্যায়ন করা জরুরি। বিআরটিসি যে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত যদি সেটা সঠিক প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ করা হয়।”

এ আইনজীবী বলেন, মোটর ভ্যাহিকেল অর্ডিন্যান্সের ১২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করতে হয়।

“সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত তারেক মাসুদের পরিবারের করা ক্ষতিপূরণের মামলায় সম্প্রতি হাই কোর্ট থেকে ক্ষতিপূরণের আদেশ হয়েছে। কিন্তু আদালত ওই অনুচ্ছেদ ও আইনি প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে এ আদেশ দিয়েছে। ফলে আমি মনে করি এই আদেশটি অনাকাঙ্ক্ষিত।”

পটুয়াখালীর বাউফলের ছেলে রাজীব যখন তৃতীয় শ্রেণিতে, তখনই মারা যান তার মা। বাবাও চলে যান রাজীব অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর। ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে খালার বাসায় থেকে, কঠোর পরিশ্রমে স্নাতক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ওই তরুণ।

তিতুমীর কলেজে পড়াশোনার ফাঁকে একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ করে আর আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় নিজের পাশাপাশি ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চালাচ্ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে কিশোর বয়সী দুই ভাই পড়েছে গভীর অনিশ্চয়তায়।

দুই ভাইয়ের মধ্যে মেহেদী হোসেন যাত্রাবাড়ীর তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার সপ্তম এবং ছোট ভাই আবদুল্লাহ একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।