খুলনায় ভোট শেষে গণনা

প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টি বাকযুদ্ধ ভোটের আগে উত্তাপ ছড়ালেও খুলনা সিটি করপোরেশনে দলীয় প্রতীকে প্রথম নির্বাচন বড় ধরনের গোলযোগ ছাড়াই শেষ হয়েছে।

মাসুম বিল্লাহও সুবীর রায়বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2018, 10:04 AM
Updated : 15 May 2018, 01:19 PM

মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ চলে। এরপর কেন্দ্রে কেন্দ্রে শুরু হয়েছে গণনা।

প্রায় ৫ লাখ ভোটারের এ সিটির ২৮৯টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কেন্দ্রের ভোট অনিয়মের কারণে স্থগিত হয়েছে হয়েছে জানিয়েছেন এই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী। 

এছাড়া আরও অন্তত সাতটি কেন্দ্রের-ভেতরে বাইরে গোলযোগ, অনিয়ম, এজেন্টদের বাধা ও নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

বিএনপি অভিযোগ করেছে, অর্ধেক ভোটকেন্দ্রেই নানা ধরনের অনিয়ম ঘটেছে, কেন্দ্রে ঢুকে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর মার্কা নৌকায় সিল মেরে ব্যালট দিয়ে বাক্স ভরা হয়েছে, ধানের শীষের প্রার্থীর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে, সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানোর পাশাপাশি মারধরও করা হয়েছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলেছে, পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে ‘শান্তিপূর্ণ ও অবাধ’ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বিএনপি ‘মিথ্যা অভিযোগ’ করছে।

ভোটের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, “দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সুষ্ঠুভাবেই ভোট হয়েছে। কয়েকটি কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে, সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা।”

চার ঘণ্টার ভোট শেষে বেলা ১২টা পর্যন্ত মোটামুটি ৩০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে ধারণা দিয়েছিলেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নাজমুল কবীর।

তবে শেষ পর্যন্ত কত শতাংশ ভোট পড়ল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য এখনও নির্বাচন কমিশন জানায়নি।

এক নজরে খুলনা সিটি নির্বাচন

>> ওয়ার্ড: সাধারণ ওয়ার্ড ৩১টি, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১০টি।

>> প্রতিদ্বন্দ্বী: মেয়র পদে ৫ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন।

>> কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ: ২৮৯টি ভোট কেন্দ্র, তাতে ভোট কক্ষ ১৫৬১টি।

>> ভোটার: ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৯৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯৮৬ জন ও মহিলা ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন।

>> ইভিএমে ভোট হয় দুই কেন্দ্রে। দুই কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন তিন হাজারের মত।

নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানান, বিকাল ৪টায় ভোট শেষ হলেও ওই সময়ের মধ্যে যারা কেন্দ্রে প্রবেশ করেছেন, তাদের সবাইকেই ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

গণনা শেষে পর্যায়ক্রমে মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরের কেন্দ্রভিত্তিক ফল জানানো হবে। একীভূত ফল ঘোষণা করা হবে বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে। রিটার্নিং কর্মকর্তা সেখান থেকেই ফল ঘোষণা করবেন।

অবশ্য দুটি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হওয়ায় ওই দুই কেন্দ্রের ফলই জানা যাবে সবার আগে।

এর মধ্যে সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন ১ হাজার ৯৯ জন, আর পিটিআইয়ের জসিম উদ্দিন হোস্টেলের অস্থায়ী কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৭৯জন।

জসিম উদ্দিন হোস্টেলের অস্থায়ী কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, “ঠিক ৪ টায় ভোটগ্রহণ শেষ করা হয়েছে। বিধি মোতাবেক কিছু কাজ আছে। সেগুলো সেরে খুব স্বল্প সময়ে ইভিএমের ফলাফল দিতে পারব আশা করি।”

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাত মাস আগে এ নির্বাচনকে ঘিরে সব মহলের নজর স্বাভাবিকভাবেই খুলনার ওপর নিবদ্ধ ছিল।

বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ হল- সরকারের জনপ্রিয়তা যে তলানিতে, খুলনায় ভোটে তা প্রমাণ করা। অন্যদিকে জনগণের সমর্থন অটুট আছে বলে দাবি করে আসা আওয়ামী লীগের সামনে ছিল তা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ।

জাতীয় নির্বাচনের বছরে নিজেদের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই নির্বাচনের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন।

সকালে নগরীর সাউথ সেন্ট্রাল রোডে পাইওনিয়ার মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে  ভোট দিয়ে নৌকার প্রার্থী খালেক বলেন, “উন্নয়নের জন্য খুলনার মানুষ ঐক্যবদ্ধ। উন্নয়নের জন্য খুলনাবাসী নৌকায় ভোট দেবে এবং নৌকার জয় হবে।”

ফল যাই হোক, তা মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন বলে সাংবাদিকদের জানান ক্ষমতাসীন দলের এই প্রার্থী।

অন্যদিকে রহিমা খাতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ধানের শীষের এই প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা সুষ্ঠু ভোটের পথে ‘প্রতিবন্ধকতা’ সৃষ্টি করছে, ভোটের পরিবেশ নিয়ে ভোটাররা ‘শঙ্কামুক্ত নন’।

“সকাল সাড়ে ৭টা থেকে অভিযোগ আসতে থাকে ভোট কেন্দ্রে আমাদের পোলিং এজেন্টদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পোলিং এজেন্টরা গেলে তাদেরকে মারপিট করে তাদের কাগজপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের ফল আমি মেনে নেব। কিন্তু ভোট ডাকাতি এবং এ ধরনের দখলের নির্বাচন আমি কোনোভাবে মেনে নেব না এবং জনগণও মেনে নেবে না।”

মেয়র পদের বাকি তিন প্রার্থীর মধ্যে জাতীয় পার্টির এস এম শফিকুর রহমান মুশফিক লাঙ্গল প্রতীক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) মিজানুর রহমান বাবু কাস্তে প্রতীক এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুজ্জাম্মিল হক হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে থাকলেও স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা বেশি ছিল প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের নিয়ে।

ভোট শুরুর পর প্রথম ঘণ্টা কোথাও কোনো গোলযোগ না ঘটলেও পরে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকায় সিল মেরে ব্যালট দিয়ে বাক্স ভরার অভিযোগ পাওয়া যায়। অন্তত ৫টি কেন্দ্রের বাইরে বিএনপি প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুর চালানো হয়।

দিন শেষে ইসির উপসচিব ফরহাদ হোসেন জানান, অনিয়ম ও গণ্ডগোলের কারণে হাজী মেহের আলী রোডের ইকবাল নগর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, লবণচরার লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় ভোট কেন্দ্র তারা স্থগিত করেছেন। এই তিন কেন্দ্রে ৫৮৩১ জনের ভোট ছিল। 

এছাড়া গগনবাবু রোডের ফাতেমা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের একটি বুথে ঢুকে একদল যুবক নৌকা মার্কায় সিল মারা শুরু করলে আধা ঘণ্টা ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। পরে ওই কেন্দ্রের ৮৫টি ভোট বাতিল ঘোষণা করেন প্রিজাইডিং অফিসার জিয়াউল হক।

ভোটর চলার মধ্যেই ঢাকায় দুই দফা সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

তিনি বলেন, “আমরা খবর পাচ্ছি, অধিকাংশ কেন্দ্রে এজেন্টরা ঢুকতে পারছেন না। অতীতের মত সেই একই রূপ, একই সন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি।”

পরে নির্বাচন কমিশনের সমালোচনায় তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন নিজেদের স্বাধীনতা অস্বীকার করে সরকারের পরাধীন হওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ করেছে। এই কমিশন সরকারেরই ফটোকপি, তাদের কম্প্রোমাইজড কপি। ”

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশনে দলীয় মেয়রপ্রার্থীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে ‘শান্তিপূর্ণ ও অবাধ’ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি মিথ্যাচার করছে।

“ভোটের যে ট্রেন্ড তা দেখে মনে হয়, তারা (বিএনপি) নির্বাচনে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে সে পরাজয়কে ঢাকার জন্য এখন মিথ্যাচার করছে।”

আর নির্বাচন কমিশন বলেছে, বিএনপি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ তাদের সামনে দেয়নি।

নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বিকালে বলেন, “বিএনপির অভিযোগ সুনির্দিষ্ট নয়। যাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে তারা এজেন্ট কি না সেটাও দেখার বিষয়। পরিচয়পত্র না থাকলে তাদেরকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়।”

ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সন্ধ্যায় ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, “২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কেন্দ্র স্থগিত হয়েছে। বাকি কেন্দ্রগুলোয় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। আমরা ভোট পরিস্থিতি নানাভাবে পর্যবেক্ষণ  করেছি। চমৎকার ও সুন্দর এবং উৎসবমুখর পরিবেশে খুলনায় নির্বাচন হয়েছে।”

আরও পড়ুন