বর্ষার আগে সতর্কবার্তা দিচ্ছে এডিস মশার লার্ভা

ডেঙ্গু তো আগে থেকে ছিল, পাশাপাশি গত বছর চিকুনগুনিয়া বেশ ভুগিয়েছে রাজধানীবাসীকে। এ দুটি রোগের জন্য দায়ী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলেও তার কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না।

ওবায়দুর মাসুম নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2018, 01:47 PM
Updated : 13 May 2018, 02:23 PM

সম্প্রতি ধানমণ্ডি, কলাবাগান ও পরীবাগ এলাকার ১৮টি বাড়ি পরিদর্শন করে ১১টিতেই এডিস মশার লার্ভা পেয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। আরও কয়েকটি এলাকায়ও পাওয়া গেছে এডিস মশার লার্ভা।

বর্ষার আগে এডিস মশার এই উপস্থিতিতে ‘এলার্মিং’ বলছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এজন্য নগরবাসীর সচেতনতার অভাবকে দায়ী করেছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

গত ৮ এপ্রিল থেকে এডিস মশার লার্ভা ও প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সহায়তায় ডিএসসিসির পাঁচটি অঞ্চলে একটি করে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়।

ডিএসসিসির অঞ্চল-১ এর মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট কমিটি ধানমণ্ডি, কলাবাগান, পরীবাগ ও এলিফ্যান্ট রোডের ১৮টি বাসা পরিদর্শন করে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন পাঠায়; তাতেই এডিস মশা পাওয়ার এ চিত্র উঠে আসে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৮ এপ্রিল ধানমণ্ডি এলাকার সাতটি বাড়ি পরিদর্শন করে কমিটি। এরমধ্যে তিনটিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। ২২ এপ্রিল কলাবাগানের ছয়টি বাড়ি পরিদর্শন করে চারটি বাড়িতে লার্ভা পায়। ৬ মে পরীবাগের পাঁচটি বাড়ি পরিদর্শন করে চারটিতেই পায় লার্ভা।

এডিস প্রজাতির এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস এলবোপিকটাস মশা; এ থেকেই চিকুনগুনিয়া রোগের সংক্রমণ ঘটে

প্রতিবেদনে বলা যায়, এসব বাড়ির পানির ড্রাম, ফুলের টব, ঘরের আশেপাশে পড়ে থাকা মাটির ভাঙা হাঁড়ি-পাতিল, পরিত্যক্ত কলসি, বালতি, বোতল, কনটেইনার, টায়ার, পলিথিন ব্যাগ, ছোট-বড় গর্ত, নালা ও পুকুরে জমে থাকা পানিতে মশার লার্ভা রয়েছে।

লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে দুটি নির্মাণাধীন বাড়ির পানির চৌবাচ্চা, কংক্রিট মিকশ্চার মেশিনের ভেতরেও।

ডিএসসিসির অন্য অঞ্চলগুলো পরিদর্শন করেও এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন কমিটিতে থাকা কর্মকর্তারা।

ডিএসসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বকশীবাজার এলাকার ১৫ বাড়ি পরিদর্শন করে ৪টি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসি অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম আনসারুজ্জামান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের অঞ্চলে এডিস মশার উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও চারটা আবাসিক বাড়িতে পেয়েছি। সেখানে মশার ওষুধ দেওয়া হয়েছে।”

ডিএসসিসির অঞ্চল-২ এবং অঞ্চল-৫ এ ও পরিদর্শন কার্যক্রম চলছে। তবে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান অঞ্চল-২ এর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন। তিনি অঞ্চল-৫ এর স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করছেন।

নিশাত পারভীন জানান, কিছু কিছু জায়গায় লার্ভা পাওয়া গেছে। নির্মাণাধীন ভবনে লার্ভার উপস্থিতি বেশি।

“আমাদের একাধিক দল কাজ করছে। আমাদের স্প্রে-ম্যানরা নিয়মিত বাসাবাড়িতে যাচ্ছেন। লার্ভার উপস্থিতি পেলে আমাদের জানাচ্ছেন। এছাড়া সেসব জায়গায় মশার ওষুধ ছিটিয়ে দিচ্ছেন।”

হাতিরঝিলে মশার লার্ভা (ফাইল ছবি)

খিলগাঁও, মাদারটেক, মালিবাগ, মৌচাক, গুলবাগ এলাকায় এডিস মশার লার্ভাস পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। ধলপুর এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার কোনো বাড়িতে লার্ভা পায়নি।

ঢাকায় এবার এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ার কোনো রোগী শনাক্ত না হলেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে বলে জানান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গু এখন আর আউটব্রেক হিসেবে না, নরমালি যেটা থাকে সেটা আছে। অতিরিক্ত কোনো কেইস হয়নি। আর চিকুনগুনিয়ার কেস এখনও আমরা পাইনি।”

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করা জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সে জরিপই সতর্ক হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

“এখনও কোনো এরকম কেস আসে নাই, হতে কতক্ষণ? এটা ঠিক যে লার্ভা আছে। যদি ব্যবস্থা না নেই এই লার্ভাই বড় মশা হবে। এজন্য মানুষকেও সচেতন করা দরকার।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা দুই সিটি করপোরেশনের ৯৩টি ওয়ার্ডের ১০০টি জায়গায় গত জানুয়ারি মাসে জরিপ চালায়। এরমধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৯টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪১টি জায়গায় জরিপ হয়। জরিপ শেষে ১৯টি এলাকাকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তারে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা

মশার উপদ্রব নিয়ে সমালোচনায় থাকা সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাহ উদ্দিন নাগরিকদের অসচেনতাকেই দায়ী করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বাড়ি বাড়ি চেক করছি, কোথাও পাওয়া গেলে আমরা ধ্বংস করে দিয়ে আসছি। কিন্তু আমাদের পক্ষে তো বারবার সেসব বাড়িতে যাওয়া সম্ভব না। এজন্য আমাদের পাশাপাশি জনগণের সচেতন হওয়া দরকার।”

গত ১৯ মার্চ নগর ভবনে এক অনুষ্ঠানে মেয়র সাঈদ খোকন কোনো বাসা বাড়িতে কারও অসচেতনতার কারণে এডিস মশার প্রজনন হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

এখন এডিস মশার উপস্থিতির পরিমাণ দেখে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোন এলাকার কী অবস্থা, তা দেখতে আমি এলাকাগুলো পরিদর্শন করতে বলেছিলাম। কিন্তু প্রথমবারে যা দেখলাম, সেটা এলার্মিং।

“আমি ভাবিনি যে এত পরিমাণে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যেতে পারে। ৮০ পার্সেন্টের মতো জায়গায় এডিসের উপস্থিতি আমাদের ধারণাও বাইরে।”

মশা নিধনে স্বয়ং মেয়র

রমজানের শুরুতেই চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু মোকাবেলায় ডিএসসিসির কর্মসূচি পুরোদমে শুরু হবে বলে জানান মেয়র।

“ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের যা যা করতে হয় আমরা করব। যেটাই হোক, আমরা এটাকে বাড়তে দেব না। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে।”

এডিসের লার্ভা পেলে সেখানে ওষুধ ছিটিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বাড়িটি চিহ্নিত করে রাখা হচ্ছে বলে জানান মেয়র।

“ওই বাড়িতে পুনরায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”