ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে অন্তিমযাত্রায় কবি বেলাল চৌধুরী

ভালোবাসার ফুলের সৌরভ মেখে অনন্তের পথে যাত্রা করলেন কবি বেলাল চৌধুরী। শোকার্ত প্রিয়জনরা ভালোবাসার পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ করে বললেন, কবির দেহটি না হয় রইল না, কিন্তু স্বীয় সৃষ্টিতে প্রিয় কবি ‘বেলাল ভাই’ চিরকাল রয়ে যাবেন ‘কবিতার কমলবনে’।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2018, 10:14 AM
Updated : 25 April 2018, 03:16 PM

বুধবার সকালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজন করা হয় নাগরিক শ্রদ্ধা নিবেদনের।

সকাল ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবির মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে আসেন তার ছেলে আব্দুল্লাহ ইউসুফ প্রতীক চৌধুরী, ভাতিজা অধ্যাপক-অনুবাদক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ সামাদসহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা।

শহীদ মিনারে প্রথম কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

তিনি বলেন, “কবি বেলাল চৌধুরী তার কবিতার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মূল্যবোধগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।”

পরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

ওবায়দুল কাদের তার সাংবাদিকতা জীবনে কবি ও সাংবাদিক বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে তার সখ্যতার কথা বলেন। কবির অন্তিম মুহূর্তের স্মৃতিচারণও করেন তিনি। তার চোখে কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন ‘সাহিত্যের বটবৃক্ষ’।

“কবি বেলাল চৌধুরী ভিন্ন মাত্রার কবি ছিলেন। তার কবিতায়, লেখনীতে বারবার বাংলার মাটি, মানুষ ও আকাশের কথা উঠে এসেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, কবি বেলাল চৌধুরী কলকাতাতেও সমান জনপ্রিয় ছিলেন।

সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বলেন, “বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কবিতা আন্দোলনে কবি বেলাল চৌধুরী অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিদের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের সেতুবন্ধন তিনি রচনা করে গেছেন।”

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।

নূর বলেন, “তার কবিতা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। বেলাল ভাই সারা জীবনভর দেশের মানুষ আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছেন। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ নিজের কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন। আপাদমস্তক বাঙালি এই মানুষটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন।”

সংস্কৃতিকর্মীরা কোনো বিপদে পড়লেই সবার আগে কবি বেলাল চৌধুরীর দ্বারস্থ হতেন বলে জানান তিনি।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আশা করেন, নতুন প্রজন্মের কবিরা কবি বেলাল চৌধুরীর ভাবনা-চিন্তাকে ধারণ করে সাহিত্যাঙ্গনে একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবেন।

কবির নশ্বর দেহটি না থাকলে তার স্বীয় সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি চর্চিত হবেন, মূল্যায়িত হবেন বলেও বিশ্বাস তার।

আশির দশকে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর শুরু হলে তাতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী।

তার সেই অবদানের কথা স্মরণ করে কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের রূঢ়, কঠিন আবহাওয়ার সঙ্গে বাংলার কোমল আবহাওয়ার মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটি নতুন আবহে নবপ্রণালী রচনা করে গেছেন কবি বেলাল চৌধুরী।”

জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ সামাদ বলেন, “তার কাব্যসম্ভার বলে দেয়, দেশের মানুষের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ ছিলেন তিনি।”

শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, উদীচী, রাইটার্স ক্লাব, ভারতীয় দূতাবাসসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে কবির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি ফেনীর শর্শদি গ্রামে, যেখানে জন্মেছিলেন তিনি। সেখানেই রাতে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা, মা আর স্ত্রীর কবরের পাশ তাকে সমাহিত করা হয়।

দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ কবি বেলাল চৌধুরী রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার দুপুরে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর জন্ম নেওয়া বেলাল চৌধুরী ছিলেন নয় ভাইবোনের বড়।

ছাত্রাবস্থায় জড়িয়ে পড়েন বামধারার রাজনীতিতে, পরে ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি জেলও খাটেন।

ষাটের দশকে কলকাতাবাসের সময় সাহিত্য পত্রিকা কৃত্তিবাস সম্পাদনায় যুক্ত হন। পরে তিনি পল্লী বার্তা, সচিত্র সন্ধানী ও ভারত বিচিত্রা পত্রিকায় সম্পাদনায়ও ছিলেন।

বেলাল চৌধুরী ‘বল্লাল সেন’, ‘ময়ূর বাহন’, ‘সবু্ক্ত গীন’ ছদ্মনামে লিখতেন । কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনা, শিশুসাহিত্য মিলিয়ে তার সর্বমোট গ্রন্থ সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি।

তার কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘বেলাল চৌধুরীর কবিতা’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থির জীবন ও নিসর্গ’, ‘জলবিষুবের পূর্ণিমা’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘বত্রিশ নম্বর’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে’, ‘বিদায়ী চুমুক’ ইত্যাদি।

তার কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’, ‘ডুমুরপাতার আবরণ’, ‘চেতনার রঙ চন্দ্রশিলা’,  ‘লাকসাম দাদা ও অন্যান্য গল্প’ ইত্যাদি।

গদ্যনির্ভর গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘কাগজে কলমে’, ‘মিশ্রচিত্রপট’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘নবরাগে নব আনন্দে’, ‘সুন্দরবন, সোঁদরবন ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মুহূর্তভাষ্য’, ‘বল্লাল সেনের ব’কলমে বেলাল চৌধুরীর রোজনামা’ ইত্যাদি।

শিশুকিশোরবিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’, ‘সপ্তরত্নের কাণ্ডকারখানা’, ‘সবুজ ভাষার ছড়া’ ইত্যাদি।

গদ্য-পদ্যের পাশাপাশি বেলাল চৌধুরী পাশ্চাত্যের কবি বোর্হেস, নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্টাভিও পাজের মতো কবিদের লেখা তর্জমাও করেছেন। সম্পাদনা করেছেন বেশকিছু স্মারকগ্রন্থও।

সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্প’, ‘বিশ্বনাগরিক গ্যেটে’, ‘পাবলো নেরুদা-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘শামসুর রাহমান সংবর্ধনাগ্রন্থ’, ‘পদাবলী কবিতা সংকলন’, ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি।

অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের মৃত্যুর কড়ানাড়া’, ‘তিন হাত ঘুরে’, ‘ত্রাস্তেরো’, ‘তাজউদ্দীন আহমেদের ডায়েরি (১-৫ খণ্ড) ইত্যাদি।

বেলাল চৌধুরী কলকাতা থেকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, যোগ দেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। এসময়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলী কবিতা সংগঠন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বেলাল চৌধুরী পেয়েছেন একুশে পদক। পরে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নীহাররঞ্জন স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ সম্মাননাসহ নানা সম্মাননা পেয়েছেন।

বেলাল চৌধুরীর তিন পু্ত্রকন্যা হলেন, আব্দুল্লাহ প্রতীক ইউসুফ চৌধুরী, সাফিয়া আক্তার চৌধুরী মৌরী ও আব্দুল্লাহ নাসিফ চৌধুরী পাবলো।