ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: ৬ ধারার সংশোধন চায় সম্পাদক পরিষদ

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছয়টি ধারাকে ‘বাক স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি’ হিসেবে বর্ণনা করে সেগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকদের একটি সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2018, 10:21 AM
Updated : 19 April 2018, 11:23 AM

সচিবালয়ে বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে এক বৈঠকে ১২টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা তাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন।

এই উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি ঠিক করেছে, তাদের হাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য থাকা ওই আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার আগে স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকে সম্পাদক পরিষদকে ডাকা হবে।

সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, নিউজ টুডের সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, নিউ এজের নূরুল কবির, প্রথম আলোর মতিউর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নঈম নিজাম, ইনকিলাবের এ এফ এম বাহাউদ্দিন এবং ফাইনানশিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক এ এইচ এম মোয়াজ্জেম হোসেন সভায় অংশ নেন।

যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, সংবাদের খন্দকার মনিরুজ্জামান, বণিক বার্তার দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, কালের কণ্ঠের ইমদাদুল হক মিলন এবং নয়া দিগন্তের সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনও অংশ নেন বৈঠকে।

এছাড়া ছিলেন লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক।

তিন মন্ত্রীর সঙ্গে দেড় ঘণ্টার রুদ্ধদার বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে মাহফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, “সম্পাদক পরিষদের অনুরোধে এই সভা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বলতে চাই, উনাদের (তিন মন্ত্রী) যে স্পিরিট আমরা দেখলাম, উনাদের যে সহযোগিতার স্পিরিট এবং আমাদের কনসার্নগুলো উনারা যেভাবে গ্রহণ করলেন এবং যে প্রস্তাব উনারা দিয়েছেন… স্থায়ী কমিটিতে যে আলোচনা হবে সেখানে উনারাই প্রস্তাব করবেন সম্পাদক পরিষদকে যেন ডাকা হয় এবং সেখানে যেসব কনসার্ন আছে আমরা তা তুলে ধরব।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা নিয়ে সম্পাদক পরিষদের উদ্বোগের কথা জানিয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, “আমরা মনে করছি, এগুলো বাক স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার পরিপন্থি।

“এবং এটা আমাদের যে স্বাধীন সাংবাদিকতা, যেটা নিয়ে বাংলাদেশে আমরা খুবই গর্ববোধ করি, সেটা খুব গভীরভাবে ব্যাহত হবে এবং এ কথাগুলো উনাদের বলেছি, উনারা খুবই সানন্দে গ্রহণ করেছেন।”

মাহফুজ আনাম আশা প্রকাশ করেন, যে আইনটি হবে, তা সত্যিকার অর্থেই সাইবার ক্রাইম ঠেকাতে ব্যবহার করা হবে, তাতে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব হবে না।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছয়টি ধারা নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও সম্পাদক পরিষদ এ আইন প্রণয়নের পক্ষে বলে জানান সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক।

“আমরা এটাও বিশ্বাস করি যে সত্যিকার অর্থে একটা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাংলাদেশে প্রয়োজন, কেননা এখন যে ধরনের সাইবার ক্রাইম হচ্ছে এবং আমরা দেখছি অনেক ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনিয়ন্ত্রিত অনলাইন মিডিয়া… অনেকভাবে তারা উদ্যোগ নিচ্ছেন, যেটা আমাদের কনসার্ন বাড়ায়…।

“আইনটা হোক, সুষ্ঠু আইন, যে আইনটা আসলে তার পারপাস সার্ভ করবে এবং স্বাধীন সাংবাদিকতাকে কোনোভাবেই তারা ব্যাহত করবে না, এটাই আমাদের বিশ্বাস।”

সম্পাদকদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, তারা যে আপত্তিগুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলো ‘অনেকাংশে যৌক্তিক’ মনে করায় আগামী ২২ এপ্রিল সংসদীয় কমিটির সভায় এডিটরস কাউন্সিলকে রাখার প্রস্তাব করা হবে।

ওই সভার পর সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো লিখিতভাবে স্থায়ী কমিটিকে দেবে।

সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হচ্ছে জানিয়ে আনিসুল বলেন, “এটা ফ্রিডম অব প্রেস বা ফ্রিডম অব স্পিচ বন্ধ করার জন্য না। সেইক্ষেত্রে এই আইনের মধ্যে যদি কোনো ত্রুটি থেকে থাকে, তাহলে পরে সেগুলো যেন অপসারণ করা যায়, সেইভাবে যেন আইনটা সংধোশন করা হয় সেই আলোকে এডিটরস কাউন্সিলের সাথে স্থায়ী কমিটির সেই আলোচনা হবে এবং এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা দুপক্ষই আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারি, তাদের যে কনসর্ন, আমরা দূর করতে পারব।”

দেশের টেলিভিশনগুলোর সমাপ্দকদের আলাদা সংগঠন রয়েছে। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক ইন্টারনেট সংবাদপত্র রয়েছে, এসব সংগঠনে যাদের প্রতিনিধিত্ব নেই।  

টিভি চ্যানেলের সম্পাদকদেরও স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে ডাকা হবে কি না- সেই প্রশ্ন আইনমন্ত্রী বলেন, “এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করব, তারা সিদ্ধান্ত নেবেন ডাকবেন কি ডাকবেন না। এমন একটা আইন করতে চাই যেটা গ্রহণযোগ্য না যুগপোযোগী হবে।

গত ২৯ জানুয়ারি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। বহুল আলোচিত এই আইনের খসড়া আইনসভার অনুমোদনের জন্য গত ৯ এপ্রিল সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার।

খসড়া আইনটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

সমালোচিত ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা তথ্য প্রযুক্তি আইন থেকে সরিয়ে সেগুলো আরও বিশদ আকারে যুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হচ্ছে।

এ আইন পাস হলে হ্যাকিং; ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’; রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে বা ভয়ভীতি সৃষ্টির জন্য কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং ডিজিটাল উপায়ে গুপ্তচরবৃত্তির মত অপরাধে ১৪ বছরের কারাদাণ্ডের পাশাপাশি কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

আর ইন্টারনেটে কোনো প্রচার বা প্রকাশের মাধ্যমে ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত’ করার শাস্তি হবে ১০ বছরের জেল, ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

খসড়া আইনটির মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর থেকে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে। সাংবাদিকরাও প্রস্তাবিত আইনটির ৩২ ধারায় সমালোচনা করছেন। এই আইনের ফলে প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে বলে মনে করছেন তাদের অনেকে।

ওই ধারায় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডর বিধান রাখা হয়েছে।

খসড়া আইনটির মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে বলে ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।

২০০৬ সালে হওয়া আইসিটি আইন ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনে সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ড করা হয়। আর ৫৭ ধারার অপরাধকে করা হয় জামিনঅযোগ্য।

ওই ধারাকে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি দাবি করে সেটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার কর্মীরা।

৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলে আসছিলেন, তথ্য-প্রযুক্তি আইন থেকে ৫৭ ধারা বাদ দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এ বিষয়ে ‘বিভ্রান্তি’ দূর করা হবে।

কিন্তু এখন তথ্যপ্রযুক্তি আইন থেকে সরিয়ে ওই ধারার বিষয়বস্তু আরও বিশদ আকারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সন্নিবেশ করা হলে তাতে অপব্যবহারের সুযোগ বন্ধ হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাবে বলে মনে করছেন অধিকারকর্মীরা।