যেভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে জামালপুর কমিউটার

টঙ্গীতে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাওয়ার সময় মাঝপথে পয়েন্টস বদলে যাওয়ায় ঢাকাগামী জামালপুর কমিউটার দুর্ঘটনায় পড়ে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

আসিফ মাহমুদ অভিআবুল হোসেন ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2018, 04:45 PM
Updated : 15 April 2018, 05:06 PM

এ দুর্ঘটনার জন্য স্টেশন কর্তৃপক্ষের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠলেও তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছেন রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক।

রোববার বেলা সোয়া ১২টার দিকে টঙ্গী জংশন থেকে সামান্য দূরে নতুন বাজার এলাকায় এই দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে চারজনের, আহত হয়েছেন অন্তত ২৬ জন।

জয়দেবপুর রেলওয়ে জংশন পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক এসএম রাকিবুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, জামালপুর থেকে ছেড়ে আসা কমিউটার ট্রেনটি টঙ্গী স্টেশন পার হওয়ার পরপরই দুর্ঘটনায় পড়ে।  

আপ লাইন (ঢাকা থেকে যে লাইনে ট্রেন টঙ্গী যায়) থেকে ট্রেনটি লাইন ক্রস ওভার পয়েন্টস দিয়ে (দুই লাইনের মাঝে সংযোগকারী তৃতীয় লাইন) ডাউন লাইনে (টঙ্গী থেকে যে লাইনে ট্রেন ঢাকায় যায়) যাচ্ছিল। ইঞ্জিন আর সাতটি বগি ঠিকমতই পার হয়ে যায়।

কিন্তু তখনই ডাউন লাইনের পয়েন্ট সরিয়ে নেওয়া হলে পেছনের বগিগুলো দুর্ঘটনায় পড়ে।

উপ-পরিদর্শক রাকিবুল বলেন, “একটি ডেমু ট্রেন ঢাকা থেকে গাজীপুরের দিকে যাচ্ছিল। স্টেশন মাস্টার ডেমু ট্রেনটি পাস করিয়ে দিতে হঠাৎ ডাউন লাইনের পয়েন্টার চেইঞ্জ করে দেয়। কিন্তু কমিউটার ট্রেনের পেছনের তিনটি বগি তখনও পার হতে পারেনি। তার মধ্যে একটি বগি দুই লাইনের মাঝখানে আটকে কাত হয়ে যায়।”

ইঞ্জিনের গতির কারণে ওই অবস্থায় এক লাইনে মাথা আর আরেক লাইনে লেজ নিয়ে ট্রেনটি ছেচড়ে আনুমানিক দেড়শ ফুট এগিয়ে যায়।

তবে মাত্র টঙ্গী স্টেশন ছেড়ে আসা ট্রেনটি তখনও পূর্ণ গতিতে ছিল না। ফলে দুর্ঘটনা আরও ব্যাপক আকার পায়নি বলে মনে করছেন রেল কর্মকর্তারা।

 

 


By Emdx - Own work, CC BY 3.0, Link

যেভাবে কাজ করে রেলের ক্রস ওভার পয়েন্টস। উইকিমিডিয়া কমনস থেকে।

দুর্ঘটনায় পড়া বগিগুলো- দুই দিক থেকে। উপরের ছবিটি তোলা ঢাকার দিক থেকে। আর নিচেরটি টঙ্গীর দিক থেকে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, ট্রেনের প্রতিটি বগি থাকে দুটো ট্রলির ওপর। প্রতিটি ট্রলিতে থাকে চারটি করে চাকা।

“আমরা যেটা বুঝতে পারছি, পয়েন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কোনো বগির সামনের ট্রলি ঠিকই লাইনে ঢুকেছে। কিন্তু পেছনের ট্রলি আরেকদিকে চলে গেছে। এ কারণেই দুর্ঘটনা।”

ঘটনাস্থলে অনেকেই এ দুর্ঘটনার জন্য স্টেশন মাস্টার হালিমুজ্জামানকে দায়ী করলেও এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা যায়নি।

কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি মো. ইয়াসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যতক্ষণ টঙ্গীতে ছিলাম ততক্ষণ স্টেশন মাস্টারকে পাইনি। ফোনও ধরেননি। উনার ত্রুটির কারণেই সম্ভবত এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। এ কারণেই হয়ত তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

ওই দুর্ঘটনা যখন ঘটে, তখন বহু মানুষ ছিল ট্রেনের ছাদে; যদিও এভাবে ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ নিষিদ্ধ।   

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াসিন জানান, ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ার সময় ছাদে থাকা আতঙ্কিত যাত্রীদের অনেকে পড়ে যান। অনেকে আবার লাফিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। মূলত তারাই এ ঘটনায় হতাহত হয়েছেন। 

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনটি লাশ উদ্ধার করেন। আরও ২৬ জনকে উদ্ধার করে পাঠান হাসপাতালে। স্থানীয়রাও বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

আহতদের মধ্যে সাতজনকে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে আরও একজনের মৃত্যু হয়।

টঙ্গী ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. আতিকুর রহমান বলেন, “অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় কমিউটার ট্রেনের চালক লাইন পরিবর্তন করার সময় কোথাও সমস্যা হয়েছে। ডেমুর চালক আগেই নিজের ট্রেন থামিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন। তা না হলে আরও বড় দুর্ঘটনা হতে পারত।”

এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রেলমন্ত্রী  মুজিবুল হক ও রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন দুপুরে টঙ্গীতে যান। পরে মন্ত্রীর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।

রেলওয় পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামানকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন  জমা দিতে বলা হয়েছে।

ঘটনাস্থলে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “হয়ত কোনো ফল্টের কারণে অথবা প্ল্যানিংয়ে ভুলের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে যে কারণেই ঘটুক, সেটি খুঁজে বের করতে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি।”

মুজিবুল হক বলেন, “এখানে যারা নিহত হয়েছেন আমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করব। যারা আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও আমরা করব। এটা আমাদের দায়িত্ব, মানবিক কারণেই এটা করবে।” 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আরিফুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এখনও অফিসিয়ালি কাগজ পাইনি। পেলেই কাজ শুরু করব।”   

ওই দুর্ঘটনার পর লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

পরে রিলিফ ট্রেন এসে প্রথমে আপ লাইন খালি করে দিলে রাস্তায় আটকে থাকা ঈশাখা এক্সপ্রেস বিকাল সাড়ে ৫টায় টঙ্গী পেরিয়ে কিশোরগঞ্জের পথে রওনা হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মিয়া জাহান জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুই লাইনই চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।