ধর্ষণ প্রমাণে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধের রায়

ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর শারীরিক পরীক্ষার তথাকথিত ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ ও ‘বায়ো ম্যানুয়াল টেস্ট’ নিষিদ্ধ করেছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2018, 10:58 AM
Updated : 12 April 2018, 03:58 PM

এক রায়ে আদালত বলেছে, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর শারীরিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে তথাকথিত ওই পরীক্ষার আইনি বা বিজ্ঞানসম্মত কোনো ভিত্তি নেই। তাই এ ধরনের পরীক্ষা অবৈধ।

পাঁচ বছর আগের এক রিট আবেদনের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি একেএম সহিদুল হক বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়। 

ওই পরীক্ষা বন্ধের দাবি জানিয়ে অধিকারকর্মীরা বলে আসছিলেন, দুই আঙ্গুলের ‘অযৌক্তিক’ ওই পরীক্ষা ভিকটিমকে আবার ধর্ষণ করার শামিল।

আদালত বলেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য বিধি অনুযায়ী গতবছর বাংলাদেশ সরকার যে হেলথ প্রটোকল করেছে, রেপ ভিকটিমদের পরীক্ষা ও ভার্জিনিট টেস্ট করতে হবে সেই বিধি মেনে।

গতবছর করা সরকারের ওই প্রটোকল দেশের সব নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এবং হাসপাতালে পাঠিয়ে তা অনুসরণ করতে বলেছে হাই কোর্ট।

ওই দুই পরীক্ষায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের পরীক্ষা করার সময় একজন গাইনোকলজিস্ট, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, নারী পুলিশ কর্মকর্তা এবং প্রয়োজনে ভিকটিমের একজন নিকট আত্মীয়কে সেখানে রাখতে হবে।

আদালত বলেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যনালকে নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো পক্ষের আইনজীবী যেন ভিকটিমকে মর্যাদাহানিকর কোনো প্রশ্ন না করে।

নির্দেশনা

>> সরকারের প্রণীত হেলথ রেসপন্স টু জেন্ডারবেস প্রটোকলটি সব ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, ধর্ষণ মামলা তদন্তকারী পুলিশ, নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর এবং আগ্রহী আইনজীবীদের কাছে সরবরাহ করতে হবে। হেলথ কেয়ার প্রোটোকল বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করতে হবে।  

>> টু ফিঙ্গার টেস্ট বিজ্ঞনসম্মত, নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে এই টেস্টটি অবৈধ। যেহেতু এই টেস্টটি বিজ্ঞানসম্মত, নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয় এবং অবৈধ তাই এখন থেকে ধর্ষিতার স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে টু ফিঙ্গার টেস্ট করা যাবে না।

>> নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালসহ সব আদালত এখন থেকে এটা নিশ্চিত করবে যে, ধর্ষিতাকে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রশ্ন করবে না যে প্রশ্নে ধর্ষিতের মর্যাদাহানি ঘটে।

>> যদি ধর্ষিতের গভীর কোনো ইনজুরি থাকে তখন পরীক্ষার ক্ষেত্রে একজন গাইনোকোলজিস্টের কাছে পাঠাতে হবে এবং সেখানে লিখতে হবে, কোন কারণে ধর্ষিতের এই গভীর ইনজুরির পরীক্ষাটি প্রয়োজন।

>> কোনো ইনজুরি না থাকলে ধর্ষিত, শিশু ও তরুণীর ক্ষেত্রে স্পার্স স্পেক্যুলাম (এক ধরনের যন্ত্র) পরীক্ষা করা যাবে না।

>> ধর্ষিতের ক্ষেত্রে ‘বায়ো ম্যানুয়াল টেস্ট’ (যৌনাঙ্গ দিয়ে আঙুল বা হাত ঢুকিয়ে নারীর ওভারির অবস্থান নির্ণয় করা) করা যাবে না।

>> ধর্ষিতের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন নারী পুলিশের উপস্থিতি থাকতে হবে, অথবা ধর্ষিতের নিকটাত্মীয় কেউ থাকতে হবে। প্রয়োজনে নারী চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষাটি করতে হবে।

>> ধর্ষিতের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞ মতামতে বা প্রতিবেদনে ‘হাইমেন রাপচার’ বা ‘হেবিচ্যুয়েটেড টু সেক্স (অভ্যাসগত যৌনতা)’ এই ধরনের শব্দগুলো ব্যবহার করা যাবে না।

>> পরীক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই ধর্ষিতের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। 

প্রতীকী ছবি

টু ফিঙ্গার টেস্ট কী?

দুই আঙুল ব্যবহার করে যোনিমুখ ও হাইমেন (যোনিমুখের পর্দা) পরীক্ষাকে বলা হয় টু ফিঙ্গার টেস্ট।

হাইমেনকে একটি গোলাকার ঘড়ির ফ্রেম হিসেবে কল্পনা করে নিয়ে  চিকিৎসক এ পরীক্ষায় বোঝার চেষ্টা করেন ওই পর্দা অক্ষত কি না।

ঘড়ির উপরিভাগে কাঁটার ৩ বা ১০ এর ঘরে হাইমেন ছেঁড়া থাকলে পরীক্ষক মনে করেন, ভিকটিমের অসম্মতিতে কোনো যৌন সংসর্গ হয়নি।  

আর হাইমেনের নিচের অংশে ঘড়ির কাঁটার ৫ বা ৮ এর ঘরের যায়গায় ছেঁড়া থাকলে পরীক্ষক ‘বল প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে’ বলে ধরে নেন।  

কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ পদ্ধতিতে ধর্ষণ পরীক্ষার কোনো ভিত্তি নেই বলে তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন অধিকার কর্মীরা।

তাদের যুক্তি ছিল, শারীরিক সম্পর্ক ছাড়াও নানা কারণে হাইমেন ছিন্ন হতে পারে। তাছাড়া সেই নারী বিবাহিত হলে টু ফিঙ্গার টেস্টে আদৌ কিছু বোঝা সম্ভব নয়।

তাছাড়া ধর্ষণের শিকার একজন নারী বা শিশুকে যেভাবে ওই পরীক্ষা করা হয়, তা তার অবমানাকর এবং ফের ধর্ষণের সমতুল্য বলে আসছিলেন অধিকারকর্মীরা। 

এ নিয়ে বছর চারেক আগে ভারতেও ব্যাপক আলোচনা হয়। পরে আদালতের নির্দেশে গঠিত একটি কমিশন ওই পরীক্ষা বন্ধের সুপারিশ করে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও একটি নির্দেশিকা তৈরি করে দেয়।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, নারীপক্ষ এবং দুই চিকিৎসক রুচিরা তাবাসসুম ও মোবারক হোসেন খান দুই আঙুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষার পদ্ধতিকে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৩ সালে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন।

ওই পরীক্ষাকে সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৩৫(৫) ও সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার পরিপন্থি দাবি করা হয় সেখানে।

এ বিষয়ে শুনানি করে রুল দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ। ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও ফরেনসিক বিভাগের প্রধানকে ডেকে এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যাও শোনে আদালত। পাশাপাশি ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের ডাক্তারি পরীক্ষার বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নে কমিটি গঠনের নির্দেশ  দেওয়া হয়।

ওই সময় দেওয়া রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ ও ‘বায়ো ম্যানুয়াল টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে রায় দিল হাই কোর্ট।

তাদের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, শারমিন আক্তার।

রায়ের পর শারমীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালত বলেছে এখন থেকে সরকারের এই প্রটোকল মানতে দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল বাধ্য থাকবে এবং এখন থেকে টু ফিঙ্গার টেস্ট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেলথ প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশে যে প্রটোকলটি করা হয়েছে, সেখানে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর পরীক্ষা কীভাবে হবে, তা বিশদভাবে বর্ণনা করে দেওয়া আছে বলে জানান তিনি।

এই আইনজীবী বলেন, “সেখানে কোথাও টু ফিঙ্গার টেস্টের কথা উল্লেখ নেই। ফলে ম্যান্যুয়ালটি ফলো করে পরীক্ষা করতে হবে।”