কোটা সংস্কার আন্দোলন ‘চলবে’

সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ভেঙে অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভক্তি ঘুচিয়ে আন্দোলনে ফিরেছেন সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পুরনো নেতারা। 

নিজস্ব প্রতিবেদকঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 April 2018, 01:28 PM
Updated : 10 April 2018, 05:47 PM

তারা বলছেন, ‘ছাত্রসমাজের’ দাবি এবং কোটা বিষয়ে কৃষি ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে তারা আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। 

সেই সঙ্গে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।

দিনের কর্মসূচি শেষ করে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে টিএসসি এলাকা ছাড়ার আগে পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজু ভাস্কর্যের সামনে আমরা অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন বহাল থাকবে।”

তাদের এ কর্মসূচির প্রতি সংহতি জানিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ

 

ফের একজোট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রোববার রাতভর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের পর সোমবার সচিবালয়ে সমঝোতা বৈঠকে ৭ মের মধ্যে কোটা ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিলেও আরেকটি অংশ তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যায়। ফলে তৈরি হয় বিভক্তি। 

মঙ্গলবার তারা সারাদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ দেখায়।  বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সংহতি জানিয়ে রাস্তায় নামে।

অন্যদিকে আন্দোলন স্থগিতের পক্ষে থাকা ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পুরনো নেতাদের এক সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ বলেন, সচিবালয়ের সমঝোতার সিদ্ধান্ত না মেনে যারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, তারা ‘অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী’।

প্রগতি সরণিতে বিক্ষোভ

সোমবার সংসদে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে? তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত হবে?”

মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য বিকালের মধ্যে প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানানো হয়। 

আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাস্তায় নামে। তাদের অবরোধ আর বিক্ষোভে রামপুরা থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রধান ফটক পর্যন্ত সড়ক এবং ধানমণ্ডির সোবহানবাগ হয়ে মিরপুর রোডে কয়েক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে।

এরই মধ্যে দুপুরে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন,বিদ্যমান কোটা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েই বলেন, আগামী বাজেটের পর এ বিষয়টি পুনঃনিরীক্ষা করা হবে।

কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের কোনো খবর না আসায় এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে দাবি পূরণের সম্ভাবনা পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীদের বিভাজন ঘুচে যায়।

পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “গতকাল সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অনুরোধে আমরা কর্মসূচি ৭ মে পর্যন্ত স্থগিত করার ঘোষণা করেছিলাম...”

“কিন্তু কাল সংসদে দাঁড়িয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ৮০ শতাংশ আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালিগালাজ করেন। এরপর আজ বিকেলে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাজেটের আগ পর্যন্ত কোটা সংস্কার সম্ভব নয়। এই দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া আমরা মানি না।”

প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন পরিষদের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান।

গত কয়েক দিনের আন্দোলনের মধ্যে গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি, রোববারের সংঘর্ষে আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং কোটার বিষয়ের প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট ঘোষণার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে আমরা বলতে চাই, আপনার সন্তানদের এই বিপদের মুখে রাস্তায় ফেলে দেবেন না, দয়া করে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিন।”

শিক্ষার্থীরা এ সময় ‘চাইলাম অধিকার হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘কোটা সংস্কার চাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।

সংবাদ সম্মেলনের পর সহস্রাধিক শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে রাজু ভাস্কর্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলিত হয়।  রাত সাড়ে৮টা পর্যন্ত সম্মিলিতভাবে তাদের বিক্ষোভ চলে।

নর্থ সাউথ,ইনডিপেন্ডেন্ট, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল, এআইইউবিসহ আন্দোলনে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অন্যতম মুখপাত্র নর্থ সাউথের বিবিএর ছাত্র আলামিন হক অপু রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরাও মাঠে থাকব। বিস্তারিত কর্মসূচি পরে জানানো হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের অবস্থা পরিদর্শনে যান সরকারের দুই মন্ত্রী আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন

সরকারের হুঁশিয়ারি

রোববার রাতের সংঘর্ষের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে যে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল, তা দেখতে মঙ্গলবার সকালে সেখানে যান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, উপাচার্যের বাসভবনে হামলায় জড়িতরা কোনোভাবেই ‘ছাড় পাবে না’। ভিডিও দেখে দোষীদের শনাক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে, ইতোমধ্যে কয়েকজনকে শনাক্তও করা হয়েছে।

সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের বৈঠকে সমঝোতা হওয়ার পরও যারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে, ‘বিদ্বেষপ্রসূত রাজনীতি ঢোকানোই’ তাদের উদ্দেশ্য বলেও মন্তব্য করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা।

তিনি বলেন, “আমি মনে করি যারা সত্যিকার অর্থে কোটা সংস্কার করতে চান, সমঝোতার পর তারা এখানে থাকবেন না। যারা থাকবেন, তারা এই আন্দোলনের সঙ্গে যে বিদ্বেষপ্রসূত রাজনীতি ঢুকে পড়েছে…. যে রাজনীতির অন্ধ আক্রোশের শিকার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, এদেরকে আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।”

এখনও যারা আন্দোলনে থাকার ঘোষণা দিচ্ছে, তারা আসলে কোটা সংস্কার চায়, নাকি দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়- সেই প্রশ্ন তুলে কাদের বলেন, “ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান কিনা, এটা খতিয়ে দেখতে হবে।”

“ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চান কিনা, এটা খতিয়ে দেখতে হবে।”

 

গ্রেপ্তার নেই কেউ?

ভিসির বাসভবনে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে থাকা ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ ইতোমধ্যে হামলার ঘটনার ‘অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। আরও প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে।

“চাক্ষুষ সাক্ষীর জবানবন্ধি আমরা নিয়েছি। হামলাকারীরা শুধু সিসি টিভি খুলে নেয়নি, হার্ড ডিস্কটাও খুলে নিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও সিসি টিভি আছে, মিডিয়ার ফুটেজ আছে। আমরা অনেক প্রমাণ পেয়েছি।”

তবে ওই ঘটনায় মঙ্গলবার থানায় কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ কমিশনার মারুফ হেসেন সরদার।

রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছি। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে যে কোনো সময় মামলা হতে পারে।”

গত কয়েক দিনে বহু আন্দোলনকারীকে আটক করার যে অভিযোগ পরিষদের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন, আন্দালনের প্রথম দিন যাদের আটক করা হয়েছিল, তাদের সবাইকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

“ভিসির বাসার হামলার আগে তাদের আটক করা হয়েছিল। ফলে তাদের সংশ্লিষ্টতার কোনো সুযোগ নেই।”

উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে রোববারের সংঘর্ষে আহতদের দেখে আসেন।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নিয়েছি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তাদের সু-চিকিৎসা দিতে অনুরোধ করেছি। আমার শিক্ষার্থীদের কেবিনে নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানীসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক এ সময় উপাচার্যের সঙ্গে ছিলেন।