কোটা সংস্কার: সরকারের আশ্বাস, আন্দোলনে বিভক্তি

শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন বিস্ফোরণোন্মুখ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরির বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে’ আগামী ৭ মের মধ্যে সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার।   

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2018, 02:13 PM
Updated : 9 April 2018, 06:01 PM

সোমবার ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিদের এক বৈঠকে এ প্রতিশ্রুতি আসার পর কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিভক্তি।   

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া অংশটি ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত জানালেও অন্য অংশটি তা বর্জন করে সরকারকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে।

মঙ্গলবার বেলা ১১টায় আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে সোমবার রাত ১০টার দিকে ক্যাম্পাস ছেড়েছে ওই অংশটি।

আগের দিন সারারাত পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘাতের পর সোমবারও দুপুর থেকে ক্যাম্পাসের রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখায় ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ ব্যানারে এই আন্দোলনকারীরা।

বিকালে তাদের ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে গিয়ে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে।

ওই বৈঠকের পর কাদের বলেন, “মে মাসের ৭ তারিখের মধ্যে সরকার রিভিউ বা পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে। রেজাল্ট কী আসে আমরা সেটা জানিয়ে দেব।… তারা কথা দিয়েছেন, ওই পর্যন্ত তারা তাদের চলমান আন্দোলন স্থগিত রাখবেন।”

ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনও সে সময় বলেন, “আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আমাদের এ আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হল। এখন পর্যন্ত আমার যে সকল ভাই বোনেরা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের সকলকে নিশর্তভাবে মুক্তি দেওয়া হবে এবং পাশাপাশি যারা আহত হয়েছেন তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবে সরকার।”

কিন্তু তারা সচিবালয় থেকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ফিরলে সেখানে অবস্থানরত আন্দোলনকারীরা ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ফলে ক্যাম্পাসে ফের উত্তেজনা তৈরি হয়।

আন্দোলনকারীরা শাহবাগ থেকে টিএসসি, দোয়েল চত্বর ও নীলক্ষেতের রাস্তা অবরোধ করে রেখে বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। অন্যদিকে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এসে ক্যাম্পাসে অবস্থান নিতে শুরু করেন।

রাত পৌনে ৯টার দিকে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয়। আর র‌্যাব সদস্যদের শাহবাগে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

আন্দোলনকারীদের নতুন নেত্রী বিপাশা চৌধুরী

এরপর রাত ১০টার আগে আগে আন্দোলনে থাকা অংশটি নতুন নেতা বেছে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। সরকারের সঙ্গে বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের বাদ দিয়ে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে বিপাশা চৌধুরীর নাম জানানো হয়। 

নতুন মুখপাত্র বিপাশা সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যারা আন্দোলন করছিলাম তারা কমিটির সিদ্ধান্তের সাথে একমত নই। আমরা আন্দোলন বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত মানি না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সরকারি ও বেরসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে যাব।” 

তিনি বলেন, “আমরা সরকারকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে কোটা সংস্কার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত না এলে ১৬ এপ্রিল ‘চল চল ঢাকা চল’ কর্মসূচিতে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ঢাকায় এসে সংস্কারের পক্ষে আন্দোলনে করবে।”

এরপর রাতের মত অবস্থানের সমাপ্তি টেনে বিপাশা বলেন, “আমরা নিরাপদ বোধ করছি না। বহিরাগত সন্ত্রাসীরা একই মধ্যে ক্যাম্পাসে চলে এসেছে এবং আমাদের ওপর তারা হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছি। তাই আজ রাতে আমরা চলে যেতে বাধ্য হচ্ছি। আগামীকাল সকাল ১১টা থেকে আবারও রাজু ভাস্কর্যের নিচে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাব।”

রাতভর সংঘর্ষের পর

বর্তমানে দেশে পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য। প্রতিবন্ধী এক শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ ৫৬ শতাংশ। ফলে এর কোনো শ্রেণিতে যারা পড়েন না, তাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাকি ৪৪ শতাংশের জন্য।

এই পদ্ধতি সংস্কারের পাঁচ দফা দাবিতে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ এর ব্যানারে আন্দোলন চালিয়ে আসছে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা।

তাদের দাবিগুলো হল- সরকারি নিয়োগে কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, কোটার যোগ্য প্রার্থী না পেলে শূন্যপদে মেধায় নিয়োগ, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা না নেওয়া, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অভিন্ন বয়সসীমা, নিয়োগপরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার না করা।

আন্দোলনরতরা রোববার শাহবাগ মোড় চার ঘণ্টা অবরোধ করে রাখার পর পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে এবং রাবার বুলেট-কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে সরিয়ে দেয়। কিন্তু এরপর বিক্ষোভ আর সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসে।

রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা চালিয়ে ভ্যাপক ভাঙচুর করা হয়। টিএসসিসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলে রাতভর। আহত হয় দেড় শতাধিক।

সকালে নিজের কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এসে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এটা সাধারণ বিক্ষোভকারীদের হামলার ঘটনা ছিল না। ‘প্রশিক্ষিত’ হামলাকারীরা মুখোশ পড়ে এসেছিল ‘প্রাণনাশের’ জন্য।

পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, উপাচার্যের বাসভবনে হামলা-ভাঙচুরের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ‘বাইরের সন্ত্রাসীরা’ ওই হামলা চালিয়েছে।

ওই সংবাদ সম্মেলনের পর আন্দোলনকারীরা আবারও রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। ওই বিক্ষোভ থেকেই দুপুরে তাদের মুখপাত্র হাসান আল মামুন সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান।

‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’

এদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনা হয়েছে। সেখানে ঠিক হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে, এবং মন্ত্রিসভাকে অবহিত করবে।

পরে আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে দশজন তরুণ ও দশজন তরুণী পুলিশের গাড়িতে করে সচিবালয়ে যান বৈঠকে অংশ নিতে। বিকাল সাড়ে ৪টায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ওই বৈঠক শুরু হয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এনামুল হক শামীম ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আফজাল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য এস এম কামাল হোসেন এবং উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামন মিয়াও বৈঠকে অংশ নেন। 

পরে ওবায়দুল কাদের ব্রিফিংয়ে বলেন, দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এক বিশেষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।

“তরুণ সমাজ, যারা আমাদের রাজনীতিতেও অপরিহার্য অংশ, এদের ব্যাপারে আমাদের একটা দুর্বলতা অবশ্যই আছে।কারণ আমরা রাজনীতিটা শুধু নেক্সট ইলেকশনের জন্য করি না, আমরা রাজনীতি করি, উন্নয়ন করি নেক্সট জেনারেশনের জন্য। কাজেই নেক্সট জেনারেশনের সুবিধা-অসুবিধা, তাদের চোখের ভাষা, মনের ভাষা আমরা বোঝার চেষ্টা করি।”

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “শেখ হাসিনা তরুণদের যৌক্তিক দাবি কখনও অবহেলা করেন না। সেই কারণে তিনি আমাদের পাঠিয়েছেন একটা মেসেজ দিতে।… বিদ্যমান যে কোটা পদ্ধতি, তা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এ ব্যাপারে একটা সমাধান খোঁজার কথা আমরা তাদের বলেছি।”

সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কে আগুন জ্বালায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

‘তাণ্ডবে জড়িতদের শাস্তি হবে’

এই আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোববার রাতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে যারা আহত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেওয়ার কথাও কাদের বলেন। তবে তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দেন উপাচার্য বাসভবনে হামলার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা ছাড় পাবে না।

বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনার সূত্র ধরে তিনি বলেন, “আমি তাদের একটা প্রশ্ন করেছি, ব্রাইট ও ব্রিলিয়্যান্ট তরুণদের, কোটা সংস্কারের সঙ্গে ভিসির কী সম্পর্ক? ভাইস চ্যান্সেলর তো কোটা সংস্কারের সঙ্গে কোনভাবেই জড়িত নয়। তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সেখানে তিনি, তার বাসভবন, তার পরিবার কেন আক্রান্ত হবে?

“এই বিষয়ে তারা আমার সাথে একমত, তারা বলেছেন, এর মধ্যে অনুপ্রবেশকারী, বাহিরাগত সন্ত্রাসীরা থাকতে পারে। এখানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছেন, আমি তাকে বলেছি, এটা দেখবেন যেন কোনো নিরীহ কেউ যেন গ্রেপ্তার হয়ে না থাকে।”

ভিডিও ফুটেজ দেখে জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে জানিয়ে কাদের বলেন, “যারা সত্যিকারের দোষী, গতকাল যে তাণ্ডব করেছে, ভিডিও ফুটেজে যারা ধরা পড়বে, তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হবে। কিন্তু এর মধ্যে যারা ইনোসেন্ট, তাদের ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছি।”

আরও পড়ুন