মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ইটের পর ইটে জনগণের অংশ

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মারক সংরক্ষণে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে জনগণের সম্পৃক্ততা।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2018, 03:58 PM
Updated : 25 March 2018, 04:11 PM

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে দশমিক ৯ একর জমির ওপর তিনটি বেজমেন্ট ও পাঁচটি ফ্লোর নিয়ে এই জাদুঘর নির্মাণে ব্যয় হয় ১০২ কোটি টাকা, যার অর্ধেকই জনগণের সহায়তার।

রোববার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নাগরিক সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্য সচিব জিয়াউদ্দীন তারিক আলী এই তথ্য জানান।

তিনি বলেন, “দেশের জনগণের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা আসা মানেই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে, মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবাসে। সেজন্যই তারা ৫১ কোটি টাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে দিয়েছে। এর মধ্যে যদিও কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ, যেমন আপনাদের অংশগ্রহণ।”

১৯৯৬ সালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় একটি ভাড়া বাড়িতে যাত্রা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। পরে আগারগাঁওয়ে স্থায়ী ভবন নির্মাণে তহবিল সংগ্রহের জন্য ১০ হাজার টাকায় প্রতীকী ইট কিনতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজারের বেশি প্রতীকী ইট কিনে নেয় সাধারণ মানুষ, যার মধ্যে স্কুলশিক্ষার্থীরাও রয়েছেন।

বাংলাদেশে নাগরিক সাংবাদিকতার প্রথম ওয়েবসাইট ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সদস্যরাও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থায়ী ভবন নির্মাণের উদ্যোগে শরিক হন। দুটি স্মারক ইটের মূল্য হিসেবে ২০ হাজার টাকার তহবিল সংগ্রহ করে ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর তুলে দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক ও মহাব্যবস্থাপক মাহাবুবুল আলমের হাতে।

এই উদ্যোগে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করে তারিক আলী বলেন, “প্রতীকী ইট কর্মসূচিতে প্রায় ১২০০ ইট বিক্রি হয়েছে। আর এর মাধ্যমে আমরা প্রায় ২০ হাজার ছেলে-মেয়ের সম্পৃক্ততা পেয়েছি। সেটি আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।”

তিনি বলেন, “অনেক স্কুলশিক্ষার্থী আছে, যারা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে একটি ইট কিনেছে। একটি স্কুলপড়ুয়া মেয়ে তার সপ্তাহের টিফিন খরচ বাঁচিয়ে সাড়ে তিন টাকা আমাদের দিয়েছে। আপনারা, এরা এবং এই স্কুলের ছাত্রীটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একটি অংশ হয়ে গেলেন। মেয়েটি যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন সে মনে করবে এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আমার টাকাও আছে।”

তারিক আলী বলেন, “১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যেমন সর্ব দলের, সর্ব মতের, সর্ব ধর্মের মানুষের ছিল, এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেও সর্ব ধর্ম, সর্ব মত, সর্ব দল, সর্ব চিন্তার মানুষ এসে ইতিহাস সম্পর্কে জানবে এবং ইতিহাস সম্পর্কে জেনে তারা নতুন কিছু করার উদ্যোগ নেবেন।”

নির্মাণ কাজ ও আনুসঙ্গিক প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর গত বছর ১৬ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এই জাদুঘরে চারটি স্থায়ী গ্যালারি রয়েছে, যার প্রতিটির আয়তন ২১ হাজার স্কয়ার ফুট। চারটি গ্যালারিতে তুলে ধরা হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের নানা দিক, স্মৃতিচিহ্ন; সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালি জাতির হাজার বছরের এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মূল্যবোধের নানা দিক।

দুটি অস্থায়ী গ্যালারিও রয়েছে জাদুঘরে, যার একটিতে কোনো গ্যালারিতে স্থান না পাওয়া স্মৃতিস্মারক রাখা হয়েছে। আরেকটিতে আছে পৃথিবীর নানা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস।

জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় উঠতেই দেখা যায় এতে সহায়তাকারীদের নামের তালিকা। সহায়তাকারীদের স্মারক ইটও দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ।

স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দীন তারিক আলীর হাত থেকে ওই স্মারক ইট গ্রহণ করেন ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নাগরিক সাংবাদিক যহরত, রিতা আহমেদ ও আমিনুর রহমান হৃদয়। 

নাগরিক সাংবাদিকদের উদ্দেশে তারিক আলী বলেন, “ব্লগাররা দেশে এবং বিদেশে নাগরিক সচেতনতা বাড়াতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আমরা জাদুঘরের সকল কার্যক্রমে তরুণদের মতকে মূল্য দিয়ে থাকি।”

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণে সহায়তায় স্মারক ইট গ্রহণের পর অনুভূতি প্রকাশে নাগরিক সাংবাদিক যহরত বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে অবিরত কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের যুদ্ধ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই জাদুঘর প্রজন্মের অহঙ্কার। ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সদস্যরা প্রজন্মের অহঙ্কারের সাথে যুক্ত হতে পেরেছে।”

ছয় বছর আগে নিজেদের সংগৃহীত অনুদানের অর্থ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তহবিলে জমা দেওয়ার স্মৃতিচারণ করে নাগরিক সাংবাদিক ও কবি নুরুন্নাহার শিরীন বলেন, “গোটা মুক্তিযুদ্ধই একটা রক্তাক্ত ইতিহাস, একটা দেশের জন্মের ইতিহাস। সেটার সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা আমাদের জন্য একটি বিশাল স্মৃতি। এ অনুভূতির কোনো তুলনা হয় না।

“এর সাথে যে তরুণ প্রজন্ম যুক্ত হয়েছে, তাদের এই যে সম্পৃক্ততা এটা একটা বড় পাওয়া। দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন এই অনুভূতি হৃদয়ে লালন করে, সেটাই একজন নাগরিক হিসেবে আমার চাওয়া।”

তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আসার আহ্বান জানিয়ে নাগরিক সাংবাদিক আমিনুর রহমান হৃদয় বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণকালে যে প্রতীকী ইট কেনার আহ্বান জানানো হয়েছিল তাতে নাগরিকদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে এবং সম্পৃক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করবে এই উদ্যোগ।”

তরুণ প্রজন্মের একজন হিসেবে নাগরিক সাংবাদিক রিতা আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণকালে প্রতীকী ইট ক্রয়ের উদ্যোগের সাথে যারা নিজেদের যুক্ত করতে পেরেছেন, তারা প্রত্যেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি।”