হবিগঞ্জের ৩ আসামির যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চূড়ান্ত

যুদ্ধাপরাধের মামলায় হবিগঞ্জের লাখাইয়ের তিন আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত চূড়ান্ত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2018, 11:45 AM
Updated : 21 March 2018, 11:53 AM

আসামিরা হলেন- শফি উদ্দিন মাওলানা (৮০), মো. তাজুল ইসলাম ওরফে ফোকন (৮০) ও মো. জাহেদ মিয়া ওরফে জাহিদ মিয়া (৬২)। তিন আসামির মধ্যে শফি উদ্দিন মাওলানা পলাতক। বাকি দুজন গ্রেপ্তার হয়ে করাগারে।

বুধবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক মো. সানাউল হক সাংবাদিকদের সামনে তদন্ত প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন।

তিন আসামিই মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধীতাকারী পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি করতেন। এদের মধ্যে শফি নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক ছিলেন, বাকি দুজন কর্মী।

সানাউল বলেন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তৎকালীণ হবিগঞ্জ মহকুমার লাখাই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন শফি। এ আসামি মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখাইয়ে শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। তার নেতৃত্বেই লাখাইয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে।

“এমনকি তার বাড়িতেই ছিল রাজাকার অফিস এবং টর্চার সেল। এখন সে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সে তালিকাভুক্ত রাজাকার। তাজুল ও জাহিদ স্থানীয় রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।”

এটি তদন্ত সংস্থার ৬০তম তদন্ত প্রতিবেদন উল্লেখ করে সানাউল হক বলেন, ‘এ নিয়ে তদন্ত সংস্থা ৬০টি মামলার তদন্ত সম্পন্ন করেছে। তার মধ্যে ৭২ আসামির বিরুদ্ধে ৩১টি মামলার রায় হয়েছে ট্রাইব্যুনালে। রায় ঘোষণার অপেক্ষায় আছে আরও একটি। ২৩টি মামলা বিচারাধীন। আরও ৩০টি মামলার তদন্ত চলছে।

আপিল বিভাগে অনিষ্পন্ন ১১টি মামলার নিষ্পত্তির জন্য আলাদা আপিল বেঞ্চ গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “নানা সঙ্কট মোকাবেলা করে তদন্তের পর ট্রাইব্যিনালে বিচার সম্পন্ন হলেও আপিল বিভাগের গিয়ে তা আটকে থাকা দুঃখজনক। আমরা এ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানাচ্ছি।”

এক প্রশ্নের জবাবে জ্যেষ্ঠ এ তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘জনদাবির প্রেক্ষিতেই সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করেছে তদন্ত সংস্থা। কিন্তু এর বিচার কী কারণে আটকে আছে তা আমরা জানি না। প্রথমে বলা হলো, সংগঠনের বিচারের বিধান নেই; আইন সংশোধন করতে হবে। তাও করা হল। এখন কী কারণে তা আটকে আছে প্রসিকিউশনকে গিয়ে আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন। যদি পুনঃতদন্তের প্রয়োজন হয় সেটা তো আমাদের বলতে হবে।”

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. নুর হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ঠিক দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালের ২২ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। টানা দুই বছর তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মত মানবতাবিরোধী অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে।

“আসামিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ আশপাশের ১০-১২টি বাড়িতে লুটপাটসহ অগ্নিসংযোগ এবং ইদ্রিস মিয়া ও আব্দুল জব্বারকে (দুই জনই মুক্তিযোদ্ধার বাবা) অপহরণ, আটক, নির‌্যাতন ও হত্যা করে।”

তিনি বলেন, এসব অপরাধে আসামিদের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। বিচারের জন্য তদন্ত সংস্থা ২১ জনকে সাক্ষি হিসেবে তুলে ধরেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।’

আসামি তাজুল ইসলাম ও জাহেদ মিয়াকে গত বছরের ২৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। তারা এখন কারাগারে আছেন বলে জানান মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নুর হোসেন।

আসামিদের বিরুদ্ধে তিন অভিযোগ

এক. ১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ২টায় আসামি মো. শফি উদ্দিন মাওলানা, মো. তাজুল ইসলাম ও মো. জাহিদ মিয়া সহযোগী রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ আশেপাশের আরও ১০-১২টি বাড়ি অভিযান চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করে এবং গান পাউডার ছিটিয়ে বাড়িগুলো পুড়িয়ে দেয়।

দুই. ১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে আসামি মো. শফি উদ্দিন মাওলানা, মো. তাজুল ইসলাম ও মো. জাহিদ মিয়া অন্যান্য রাজাকার ও একদল পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মো. ইলিয়াস কামালের বাড়িতে যান।

সে সময় ইলিয়াস কামালকে বাড়িতে না পেয়ে আসামিরা ইলিয়াসের বৃদ্ধ বাবা মো. ইদ্রিস মিয়াকে হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে একই গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য ইসমাইল মাওলানার বাড়িতে আটকে রেখে নির্যাতন করে।

তিন. ১৯৭১ সালের ৩১ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে তিন আসামি অন্যান্য রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে লাখাইয়ের মুড়িয়াউক গ্রামের আব্দুল জব্বারের বাড়িতে গিয়ে তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহানকে খোঁজাখুঁজি করে।

কিন্তু তাকে না পেয়ে আসামিরা মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহানের বৃদ্ধ বাবা আব্দুল জব্বারকে অপহরণ করে একই গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য ইসমাইল মাওলানার বাড়িতে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে।

ওইদিন বিকেলে রাজাকার ও পাকিস্তানি আর্মিরা ইদ্রিস মিয়া ও আব্দুল জব্বারকে নৌকায় করে লাখাইয়ের (আসামি মো. শফি উদ্দিন মাওলানার বাড়ির কাছে) উজাদার বিলে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়।