স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর খবর শুনলেন অ্যানি, ফিরলেন বাড়ি

নেপাল থেকে ফিরল ফারুক হোসেন প্রিয়ক ও তার মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী তামারার লাশ; আর এদিকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরলেন প্রিয়কের স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি।

কাজী নাফিয়া রহমানআবুল হোসেন ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2018, 02:05 PM
Updated : 19 March 2018, 04:21 PM

বেড়াতে নেপাল যেতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে চেপেছিলেন গাজীপুরের বাসিন্দা আলোকচিত্রী প্রিয়ক (৩২)। কিন্তু কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হলে মারা যান প্রিয়ক ও তামাররা, আহত হন অ্যানি।

কাঠমান্ডুর হাসপাতালে চার দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর দেশে এনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল অ্যানিকে। মানসিকভাবে যেন ভেঙে না পড়েন সেজন্য স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর খবরটি জানানো হয়নি তাকে।

সোমবার নেপাল থেকে নিহত অন্য ২৩ জনের সঙ্গে প্রিয়ক ও তামারার লাশ আসার আগে স্বজনরা অ্যানিকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান বাড়িতে।

বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যানির স্বামী-সন্তান মারা যাওয়ার খবর তাকে জানানোর জন্য তার স্বজনরা তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়েছে।”

অ্যানিকে (২৫) গত শুক্রবার দেশে আসার পর চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, তার ডান গোড়ালিতে ব্যথা, কিন্ত হাড় ভাঙেনি, লিগামেন্টে একটু সমস্যা হয়েছে।

অ্যানির শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে ডা. সামন্ত লাল সোমবার বলেন, “তিনি এখন মোটামুটি ভালো আছেন। তবে যেহেতু তার স্বামী মারা গেছে, তাই তার মানসিক অবস্থা কেমন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।”

অ্যানির মামা শ্বশুর তোফাজ্জল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যানিকে সকালে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রিয়ক ও প্রিয়ন্ময়ীর মৃত্যুর খবর জানাতে।”

হাসপাতালে অ্যানি (শুক্রবারের ছবি)

তোফাজ্জলের ছেলে মেহেদী হাসান অমিয় এবং মেহেদীর স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণাও ছিলেন ওই উড়োজাহাজে। মেহেদী ও স্বর্ণা বেঁচে গেছেন। তারা এখন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যেই স্বজনদের শেষ বিদায় জানাতে চিকিৎসকদের কাছে ছুটি নিয়ে আর্মি স্টেডিয়ামে উপস্থিত হন মেহেদী। 

ব্যবসায়ী মেহেদী আর আলোকচিত্রী প্রিয়ক, সম্পর্কে মামাতো-ফুপাতো ভাই এই দুজনেরই বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুরের নগর হাওলা গ্রামে।

সোমবার সকালে অ্যানি শ্রীপুরে যাওয়ার পর প্রথম শোনেন যে তার স্বামী ও সন্তান বেঁচে নেই। এই খবর শোনার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

প্রিয়কের বন্ধু মোস্তফা কামাল সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যানির কান্নায় আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে যায়। আত্মীয়, স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছিলেন।”

অ্যানির বাড়িতে আসার খবর পেয়ে সকাল থেকেই ওই বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী ভিড়। তবে স্বজনরা অন্য কারও সঙ্গে অ্যানিকে কথা বলতে দেননি।

তোফাজ্জল বলেন, “ঢাকায় আসার পর প্রথম দিন প্রিয়ক আর মেয়ের কথা খুব বলছিল অ্যানি। একটু পরপর কাঁদছিল। কিন্তু গত দুই দিন ধরে পাথর হয়ে গেছিল। কাল রাতে তাকে কিছুটা বলা হয়েছিল। কিন্তু আজকে জানানো হয়েছে।”

বাবা-মার একমাত্র সন্তান প্রিয়ক। ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ঢাকার নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন। এরপর নেশা ফটোগ্রাফিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সোমবার জানাজার জন্য ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের মরদেহ নিয়ে আসছেন সেনা সদস্যরা।

বিকালে আর্মি স্টেডিয়ামে হস্তান্তরের পর রাত ৮টার দিকে নগরহাওলা গ্রামে বাড়িতে পৌছায় প্রিয়ক ও তার মেয়ের লাশ। তখনই প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগমকে জানানো হয় ছেলের মৃত্যু সংবাদ।

তোফাজ্জল বলেন, “আমার বোনের একমাত্র সন্তান চলে গেছে সারা জীবনের জন্য। না জানায়া তো আর কবর দিতে পারি না। বোনটার অবস্থা অনেক খারাপ। ছেলের মৃত্যু সংবাদে পাগলপ্রায় হয়ে গেছেন।”

মঙ্গলবার সকালে জানাজা শেষে বাড়ির সামনের কবরস্থানে দাফন করা হবে প্রিয়ক ও প্রিয়ন্ময়ীকে। তার আগে লাশ দেখানো হচ্ছে না প্রিয়কের মা ও স্ত্রীকে।

তোফাজ্জল বলেন, “কফিন খুলে তাদের লাশ এখনও দেখাইনি। কাল সকালে দেখাব।”

এই বিমান দুর্ঘটনায় মোট ৪৯ জন নিহত হন, যার মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশি; বেঁচে যান অ্যানিসহ ১০ বাংলাদেশি।

নেপাল রওনা হওয়ার আগে শাহজালাল বিমানবন্দরে স্ত্রী-সন্তানসহ ফারুক হোসেন প্রিয়ক; ছবিতে তাদের বাম পাশে মেহেদী হাসান অমিয়র স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা

দুর্ঘটনার পরদিন নেপালে গিয়েছিলেন প্রিয়কের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইজাজ আহমেদ মিলন। জীবিতদের কাছে বিমান দুর্ঘটনার বর্ণনা শোনেন তিনি।

ইজাজ জানান, উড়োজাহাজের বাম দিকে সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন প্রিয়ক, তার ডান দিকে ছিলেন অ্যানি।

“যখন বিকট শব্দটা হল, তখনই সামনের সিটে থাকা মেহেদী তার স্ত্রী ও অ্যানিকে নিয়ে বের হয়ে যায়।”

উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গিয়েছিল, তারই একটি স্থান দিয়ে তারা তিনজন বের হন।

ইজাজ বলেন, “অ্যানি আমাকে বলেছে, প্রিয়ক তাকে বলেছিল, ‘যে কোনো উপায়ে বের হতে হবে, দ্রুত বের হও’। অ্যানিও ধরে নিয়েছিল যে প্রিয়ক বের হতে পারবে।”

কিন্তু তামাররাকে নিয়ে প্রিয়ক আর বের হতে পারেননি। সোমবার তাদের লাশ নেপাল থেকে আসার পর ঢাকা আর্মি স্টেডিয়ামে লাশ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে।