জানাজার পর ২৩ জনের মরদেহ হস্তান্তর

কেউ গিয়েছিলেন হিমালয়ের কোলে বেড়াতে, কেউবা পেশাগত কাজে; ঠিক এক সপ্তাহ পর তারা নেপাল থেকে দেশের মাটিতে ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2018, 12:17 PM
Updated : 19 March 2018, 05:04 PM

নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ সোমবার দেশে আসার পর ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে বেদনা বিধুর পরিবেশে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে তাদের কফিন হস্তান্তর করা হয়েছে স্বজনদের কাছে।

ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিএস২১১ গত ১২ মার্চ ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিল চার ক্রুসহ ৭১জন আরোহী নিয়ে, সেদিনও ছিল সোমবার। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের সময় উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হলে ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৪৯ আরোহীর মৃত্যু হয়।

নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে যে ২৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করা গেছে, তাদের কফিন নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজ সোমবার বিকাল ৪টা ৫মিনিটে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিমানবন্দরে নিহতদের মরদেহ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। বিমান পরিবহন মন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামালও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

মেয়ের লাশের অপেক্ষায় পাইলট পৃথুলা রশিদের মা

বিমানবন্দর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে কফিনগুলো নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর আর্মি স্টেডিয়ামে। সেখানেই আত্মীয়, বন্ধু, স্বজনদের সঙ্গে শেষবার মিলিত হবেন না ফেরার দেশের এই ২৩ যাত্রী।

আর্মি স্টেডিয়ামে তখন অপেক্ষা করছিলেন শত শত মানুষ। স্বজনের চোখের জল আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে স্টেডিয়ামের বাতাস।

ইউএস বাংলার ওই ফ্লাইটের কো-পাইলট পৃথুলা রশিদের লাশ নিতে আর্মি স্টেডিয়ামে এসেছিলেন তার বাবা আনিসুর রশীদ ও মা রাফেজা বেগম।

রাফেজা বলছিলেন, “আমার মেয়েকেতো হারিয়েছি। আরও অনেককে হারাইছি আমরা। যারা মারা গেছে সবার জন্য দোয়া চাই। এর বেশি আমি বলতে পারব না।”

২৩ মরদেহ হস্তান্তর

ইউএস-বাংলার পাইলট আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ; কেবিন ক্রু খাজা হোসেন মো. শফি ও শারমিন আক্তার নাবিলা; যাত্রী ফয়সাল আহমেদ, বিলকিস আরা, বেগম হুরুন নাহার বিলকিস বানু, আখতারা বেগম, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, রকিবুল হাসান, হাসান ইমাম, আঁখি মনি, মিনহাজ বিন নাসির, ফারুক হোসেন প্রিয়ক, তার মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী তামারা, মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহিরা তানভিন শশী রেজা, বেগম উম্মে সালমা, মো. নুরুজ্জামান, রফিক জামান, তার স্ত্রী সানজিদা হক বিপাশা, তাদের ছেলে অনিরুদ্ধ জামান।

নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে আলিফুজ্জামান, পিয়াস রায় ও নজরুল ইসলামের মরদেহ রোববার পর্যন্ত শনাক্ত করা বাকি ছিল। নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস সোমবার সকালে জানান, ওই তিনজনের মধ্যে একজনের লাশ শনাক্ত করা হলেও নেপালি কর্তৃপক্ষ এখনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি।

আহতরা সবাই ফিরেছেন

ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া দশ বাংলাদেশির মধ্যে যে দুজন রোববার পর্যন্ত কাঠমান্ডুর হাসপাতালে ছিলেন, তাদের মধ্যে কবির হোসেনকে ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটে সোমবার ঢাকায় এনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর নরভিক হাসপাতালে থাকা ইয়াকুব আলীকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছে ভারতের দিল্লিতে।

নিহতদের মধ্যে ২৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করার পর নেপালি কর্তৃপক্ষ কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের হস্তান্তর করে। সোমবার সকালে দূতাবাস প্রাঙ্গণে প্রবাসী বাংলাদেশি, বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ইউএস-বাংলার উপস্থিত কর্মকর্তারা তাদের জানাজায় অংশ নেন।

দুপুরে বিমানবাহিনীর একটি কার্গো ফ্লাইটে করে ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে কফিনগুলো নিয়ে আসা হয় ঢাকার শাহজালালে। বিমানবন্দর থেকে আর্মি স্টেডিয়ামে যখন কফিন পৌঁছায়, তার আগেই পরিবারের সদস্যরা জড়ো হয়েছিলেন সেখানে।

বিমান দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের স্বজনদের মধ্যে যারা কাঠমান্ডুতে গিয়েছিলেন, তাদেরও দুপুরে দেশে ফিরিয়ে এনে আর্মি স্টেডিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়।

মাওলানা মাহমুদুর রহমানের পরিচালনায় মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনসহ বিভিন্ন শ্রেণি পোশার মানুষ আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজায় অংশ নেন।

রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সরোয়ার হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী কফিনে ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

বিএনপির পক্ষ থেকে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, মো. শাহজাহান, খায়রুল কবির খোকনসহ নেতারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পরে একে একে নাম ডেকে ডেকে মরদেহ হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। ২৩ জন পুলিশ কর্মকর্তা আলাদা আলাদা ফাইলে তথ্য সংগ্রহ ও ফরম পূরণ করে ছবি ও পাসপোর্টের তথ্য দেখিয়ে মরদেহ হস্তান্তর করেন।

হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষে কফিন নিয়ে স্বজনরা রওনা হন যার যার ঠিকানায়, প্রিয়জনকে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিতে।