‘সেই সময়ের কিছু মনে করতে চাই না’

ছয় সদস্যের পর্যটক দলের চারজনই মারা গেছেন নেপালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায়। বেঁচে যাওয়া দুইজনের একজন শাহরিন আহমেদ, যার বেঁচে ফেরাকে ‘মিরাকল’ বলছেন তার স্বজনরাও।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2018, 11:02 AM
Updated : 17 March 2018, 12:26 PM

তবে সেই দুঃস্বপ্ন এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের বিছানায় শুয়ে থাকা শাহরিনকে। এখনো তার কানে বাজে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার সেই বিকট আওয়াজ।

চেষ্টা করেও কিছুতেই ভয়াল সেই স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না স্কলাসটিকা স্কুলের উত্তরা শাখার জুনিয়র এই প্রোগ্রাম অফিসার ।

বার্ন ইউনিটের ভিআইপি কেবিনে শুয়ে শাহরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তার বেঁচে যাওয়ার কথা।

গত সোমবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ৭১ আরোহীর মধ্যে ৪৯ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে চার ক্রুসহ ২৬ জন ছিলেন বাংলাদেশি। আহতদের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশি, শাহরিনই প্রথম দেশে ফেরেন।

দুর্ঘটনার পর আহত শাহরিনকে কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকালে কাঠমান্ডু থেকে তাকে দেশে এনে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।

শাহরিনের শরীরের ৫ শতাংশে ডিপ বার্ন রয়েছে এবং পায়ে ফ্র্যাকচার রয়েছে। পিঠ পুড়ে গেছে আর আগুন নেভাতে গিয়ে হাতও পুড়েছে। তবে তার অবস্থাকে স্থিতিশীল বলছেন চিকিৎসকরা।

উড়োজাহাজে সুবিধাজনক স্থানে থাকায় বাঁচতে পেরেছেন বলে মনে করেন শাহরিন।

“আমি উইংসের সামনে ছিলাম। ডানপাশের ‘৬এফ’ এ-তে ছিলাম। পড়ার পর তো কিছুই বুঝি নাই, বাড়ি খেয়ে পড়ে গেছি। হয়তো সামনের দিকে থাকাই বেঁচে গেছি।”

বিমানটি শেষ মুহূর্তে বাম কাত হয়ে অবতরণ করতে চাইছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “প্লেনটা নরমালি ছিল, জাস্ট ল্যান্ড করার সময় বাম দিকে টিল্ট করে নামছিল। আমি তখন বলছিলাম, লেফটে এমন টিল্ট করে ল্যান্ড করছে কেন? প্লেন ক্র্যাশ করবে তো।”

এরপরই উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয় বলে জানান তিনি।

হতাহতদের উদ্ধারে নেপালের ফায়ার সার্ভিস আর সেনাবাহিনীর তৎপরতায় কৃতজ্ঞতা ঝরেছে শাহরিনের কণ্ঠে।

“ওরা এতো দ্রুত কাজ করেছে- সেটা বলার বাইরে। তাদের জন্য বের হওয়া সম্ভব হয়েছে।”

দ্রুত যেন সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেন সেজন্য সবার কাছে দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, “আমি ট্রমার মধ্যে আছি। ওই সময়ের কিছুই মনে করতে চাই না। আমার জন্য দোয়া করেন, যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠি।

“যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারব, ততো তাড়াতাড়ি এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারব।”

তবে এর পর থেকে উড়োজাহাজে উঠতে ভয় পাবেন বলে জানান শাহরিন।

হাসপাতালে প্রতিদিনই শাহরিনকে দেখতে আসেন স্বজনদের কেউ না কেউ। ভাগনিকে দেখতে চট্টগ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন মামী নিলুফার আহমেদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “প্লেন ক্র্যাশের খবর টিভিতে দেখে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম আমরা। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। ও বেঁচে ফিরবে চিন্তাই করিনি।

ওর বাঁচাটা আসলে মিরাকল। এই অবস্থায় কারো বাঁচার কথা না।”

 

শাহরিনের কাছ থেকে শোনা দুর্ঘটনার সময়কার বর্ণনা দিয়ে নিলুফার বলেন, “বিমান বিধ্বস্তের পর শাহরিন ‘সেভ সেভ’ বলে চিৎকার করেছিল। ওর কাছে কেন যেন মনে হচ্ছিল, ও এভাবে মরতে পারে না। বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ ওকে বাঁচাবেন।

“আগুন নেভানোর পর মুমুসহ (শাহরিনের ডাক নাম মুমু) দুজনকে তখন এক সাথে উদ্ধার করা হয়। নিচে তো লাশ পড়েছিল। ও সিট বেল্টটা খুলতে পারছিল না। ও আমাকে বলেছে, একটা সময় ওর এমন শক্তি আসে যে ও সিট বেল্টটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে।

"ও বলেছে, ওকে বের করতে সময় লেগেছে বিশ মিনিট আর পেছনের মানুষগুলো মারা গেছে এ বিশ মিনিটেই। হয়তো আর কিছু সময় গেলে বাঁচানো যেত না। ছাদটা খুলে ওকে বের করেছিল। টেনে বের করেছিল ওকে। ওকে যখন বের করেছে, পেছনের সব মানুষ তখন মারা গেছে।"

শাহরিনের খালা মমতাজ আরা বলেন, “আমাদের সবার আদরের মুমু। ওর ভাইয়ের ১৩ বছর পরে হয়েছে। ছোট বেলা থেকেই এতো মিষ্টি কথা বলত, যে কারণে সবার পছন্দের ও। ওকে ফিরে পাব চিন্তাই করিনি।”

বিধ্বস্ত বিমানের আহত ১০ যাত্রীর মধ্যে শাহরিন ছাড়া আরো তিনজন এখন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে রয়েছেন। তারা হলেন- মেহেদী হাসান, সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা ও আলমুন নাহার অ্যানি।

শনিবার আনা হয় রাশেদ রুবায়েতকে। আরও দুজন কবির হোসেন ও মো. শাহীন বেপারিকে রোববার ঢাকায় আনা হবে বলে ডা. আজাদ জানান।

নেপালে চিকিৎসাধীন ইমরানা কবির হাসিকে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হচ্ছে ভারতে। আহত রিজওয়ানুল হককে নেপাল থেকেই সিঙ্গাপুরে নিয়ে গেছেন তার বাবা।