স্বজনরা জানিয়েছেন, একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ফিরতে গিয়ে নিজেও মারা যান প্রিয়ক।
প্রিয়কের বন্ধু ইজাজ আহমেদ মিলন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যানি, মেহেদী ও স্বর্ণা বের হতে পারলেও কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে প্লেইনটি বিস্ফোরিত হলে প্রিয়ক আর বের হতে পারেনি।
“প্রিয়কের কোলেই ছিল ওদের সন্তানটি। মেয়েকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল ও। সন্তানকে প্রচণ্ড ভালবাসতে ও। তাই তো একা বের হতে চায়নি।”
গত ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বেসরকারি সংস্থার উড়োজাহাজে যাত্রী হয়েছিলেন আলোকচিত্রী প্রিয়ক, তার স্ত্রী আলমুন নাহার অ্যানি ও মেয়ে তামারা। সহযাত্রী হয়েছিলেন প্রিয়কের বন্ধু ও মামাত ভাই মেহেদী হাসান অমিয় ও তার স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণা।
গাজীপুরের শ্রীপুরের নগর হাওলা গ্রামের এই দুই পরিবার ভ্রমণের উদ্দেশে নেপালে রওনা হয়েছিলেন।
দুর্ঘটনার পর প্রিয়কের স্ত্রী অ্যানি, মেহেদী ও তার স্ত্রী স্বর্ণাকে জীবিত উদ্ধারের পর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পাঁচ দিন কাঠমান্ডু মেডিকেলে চিকিৎসার তাদের তিনজনকে দেশে এনে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে।
দুর্ঘটনার পরদিন নেপালে তাদের দেখতে গিয়েছিলেন মেহেদীর চাচাত ভাই মাহবুব আলম ও প্রিয়কের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইজাজ আহমেদ মিলন।
জীবিত তিনজনের কাছে বিমান দুর্ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন তারা; তাতে জানতে পারেন কীভাবে মৃত্যু হয়েছে প্রিয়ক ও তার সন্তানের। স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুর খবর এখনও জানানো হয়নি আহত অ্যানিকে।
ইজাজ জানান, উড়োজাহাজের বাম দিকে সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন প্রিয়ক, তার ডান দিকে ছিলেন অ্যানি।
“যখন বিকট শব্দটা হল, তখনই সামনের সিটে থাকা মেহেদী তার স্ত্রী ও অ্যানিকে নিয়ে বের হয়ে যায়।”
উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গিয়েছিল, তারই একটি স্থান দিয়ে তারা তিনজন বের হন।
ইজাজ বলেন, “অ্যানি আমাকে বলেছে, প্রিয়ক তাকে বলেছিল, ‘যে কোনো উপায়ে বের হতে হবে, দ্রুত বের হও’। অ্যানিও ধরে নিয়েছিল যে প্রিয়ক বের হতে পারবে।”
বাবা-মার একমাত্র সন্তান প্রিয়ক। ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর রাজধানীর নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন। এরপর নেশা ফটোগ্রাফিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন।
প্রিয়কের বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। তার মাকে এখনও জানানো হযনি ছেলে ও নাতনীর মৃত্যুর খবর।
প্রিয়কের মামা ও মেহেদীর বাবা তোফাজ্জল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছেলের জন্য উনি পাগলপ্রায়। উনাকে বলা হয়েছে, ছেলে হাসপাতালে ভর্তি আছে।”
অ্যানিকে উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে তিনি প্রিয়ক ও তামারার কোনো খবর পাননি। তাকে জানানো হয়েছে, তারা দুজন আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ইজাজ বলেন, “অ্যানি সারাক্ষণই তার মেয়ে দেখতে চাচ্ছে। একটু পরপরই বলছে,আমার মেয়েটা কোথায়? ও কেমন আছে? ওর শরীরের কত অংশ পুড়ে গেছে? আমি ওকে একটু দেখব।”
শুক্রবার বিমানমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল ওই তিনজনকে দেখতে ঢাকা মেডিকেলে গেলে তার কাছেও মেয়ের খোঁজ জানতে চান অ্যানি।
তিনি বলছিলেন, “আমার মেয়েটা কিন্তু ছোট, একা খেতে পারে না, ওদের অবস্থা কি বেশি খারাপ? কখন সিঙ্গাপুরে পাঠাবেন আপনারা?”
দুর্ঘটনার পর উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যাওয়ায় অধিকাংশ মরদেহ পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। নেপালের মর্গে প্রিয়ক বা তার মেয়ের লাশ দেখার সুযোগ হয়নি স্বজনদের।
মেহেদীর চাচাতো ভাই মাহবুব আলম শুক্রবার ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, তারা প্রিয়ক আর তার মেয়ের লাশ দেখতে কাঠমান্ডুর মর্গে গেলেও তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
“আমরা বলেছিলাম, যাত্রীদের মধ্যে বাচ্চা আছে মাত্র দুটো, একটা ছেলে একটা মেয়ে। আমদের মেয়েটাকে তো সহজেই সনাক্ত করা যেত। কিন্তু তারপরও তারা দেখতে দেয়নি।”
সম্ভব হলে আগামী মঙ্গলবার থেকেই বাংলাদেশিদের মরদেহ দেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি অসিত বরণ সরকার।
তিনি শুক্রবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নিহত ৪৯ জনের ময়নাতদন্ত শুক্রবার শেষ করেছেন চিকিৎসকরা। শনিবার লাশ শনাক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এদিকে অ্যানি, মেহেদী আর স্বর্ণাকে আরও ছয় সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হতে পারে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।