পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালক্রমে তার হাত ধরেই বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তার কর্ম ও আদর্শ চিরকাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে।
“বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালি জাতির নন, তিনি বিশ্বে নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তির দূত।”
জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শিশু-কিশোরকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বাস্তবায়নে আমাদের নতুন প্রজন্মকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। জ্ঞান-গরিমা, শিক্ষা-দীক্ষা, সততা, দেশপ্রেম ও নিষ্ঠাবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে তাদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।”
পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতার ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্ব এবং সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব সমগ্র জাতিকে একসূত্রে গ্রথিত করেছিল। যার ফলে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ; বিকাশ ঘটেছে বাঙালি জাতিসত্তার।
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বাঙালি জাতিরই নয়, তিনি ছিলেন বিশ্বের সকল নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায় ও মুক্তির অগ্রনায়ক।”
জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা শিশুদের জন্য জাতির পিতার জীবন ও কর্মভিত্তিক বই প্রকাশ এবং পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সংযোজন করেছি। শিশুদের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করে তাদের ব্যক্তিত্ব গঠন, সৃজনশীলতার বিকাশ এবং আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে দল-মত নির্বিশেষে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। তাদের বাংলাদেশ ও জাতির পিতার সংগ্রামী জীবনের প্রকৃত ইতিহাস জানাতে হবে।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে শনিবার সকাল সাড়ে ৬টায় রাজধানীর ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসহ দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে আওয়ামী লীগ। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন কর্মসূচি রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলীয় প্রতিনিধিদল শনিবার সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবেন। পরে বাদ জোহর তারা দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করবেন। সেখানে শিশু সমাবেশ, গ্রন্থমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হবে।
রোববার বিকেল ৩টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আলোচনা সভা করবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জাতীয় নেতারা বক্তব্য রাখবেন।
দিবসটিতে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নেতৃত্বে শিক্ষকরা ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় উপাচারে্যর সভাপতিত্বে টিএসসি অডিটরিয়ামে ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন: রঙ ছড়ানো আলো, লাল-সবুজের বাংলাদেশে থাকবে শিশু ভালো’ শিরোনামে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। বিকালে একই জায়গায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
চারুকলা অনুষদের আয়োজনে টিএসসি ক্যাফেটারিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ, উপাসনালয় ও প্রতিটি আবাসিক হলে দোয়া, প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল, উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয় এবং নীলক্ষেত উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হবে।
গৌরব-৭১’ এর আয়োজনে সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজন করা হয়েছে শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী এ আয়োজনের উদ্বোধন করবেন।
শনিবার সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে ‘বঙ্গবন্ধুর গল্প শোনো’ শীর্ষক শিশু-কিশোর অনুষ্ঠান এবং বিকাল ৪টায় একই মঞ্চে একক বক্তৃতানুষ্ঠান হবে। সকালের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। বিকালের অনুষ্ঠানে আসবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় শনিবার বিকাল ৩টায় বিজেএমসি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে, যাতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন এই মন্ত্রণালয়ের মুহাম্মদ ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক।
জাতীয় শিশু দিবস ও জাতির পিতার ৯৯তম জন্মদিন উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) উদ্যোগে শনিবার সারা দেশে ৭১ হাজার ৫৩৫টি স্থানে কোরআনখানি, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
ইফার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আজ শুক্রবার বিকেলে এই কর্মসূচির কথা জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয়ভাবে শনিবার সকাল ১০টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের শাহাদাতবরণকারী সব সদস্যের রূহের মাগফিরাত কামনা করে কোরআনখানি মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১১টায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম ’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
ইফার জেলা কার্যালয়, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষাকেন্দ্র, মডেল রিসোর্স সেন্টার, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শনিবার সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচি শুরু হবে।
কর্মসূচির মধ্যে শিশু সমাবেশ, র্যালি, হামদ-নাত, গজল পরিবেশন, কবিতা আবৃত্তি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের থিম সং পরিবেশন ছাড়াও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের ওপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, শনিবার সকাল ১১টায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বঙ্গবন্ধুর জীবনী
টুঙ্গিপাড়ায় এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান স্কুল জীবনেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কৈশোরে তার রাজনীতির দীক্ষাগুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে প্রথমবারের মতো কারাবরণ করেন শেখ মুজিব।
ম্যাট্রিকুলেশন পাসের পর কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন শেখ মুজিব।
ওই সময় থেকেই নিজেকে ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন, যোগ দেন আওয়ামী মুসলিম লীগে, যা পরে অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আওয়ামী লীগ নাম নেয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট পালনকালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত তিনি বারবার কারারুদ্ধ হন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন জনদাবি আদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিব।
বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বারবার কারাগারে যেতে হতে হয়েছে শেখ মুজিবকে। আর আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ তাকে নিয়ে যায় বাঙালির নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগপ্রধান হিসেবে ’৬৬-এ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি, যার ফলে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।
’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়। ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির এ নির্বাচনী বিজয়কে মেনে নেয়নি।
এরপর বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রথমে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ দেন। ’৭১-এর মার্চে শুরু করেন অসহযোগ আন্দোলন।
৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে তার ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাঙালিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে ধাবিত করে।
’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করার পর সে রাতেই বন্দি হন শেখ মুজিব। তবে তার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অন্তরীণ থাকলেও তার নামেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতিও ছিলেন তিনি।
অন্যদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা ও বিদ্রোহের অভিযোগ এনে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে গোপন বিচারের নামে প্রহসন শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে।
নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু। ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন ভূমিতে পা রাখেন তিনি।
সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের দায়িত্বভার নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যদিও ওই সময়ে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে ছিল না।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেন, গঠন করেন বাকশাল; যার ফলে দেশে অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়, চারটি সংবাদপত্র ছাড়া অন্য সব সংবাদপত্রও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তার কিছু দিনের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এক দল সেনা কর্মকর্তার হাতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু।
যে দেশের স্বাধীনতার জন্য রাজপথ কিংবা কারাগারে যার জীবন কেটেছে, সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অবসান ঘটে স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কের এবং তা বাঙালিরই হাতে।